দায়িত্ব পালনের সময় স্বচ্ছতা বজায় রাখতে ‘বডিওর্ন ক্যামেরা’ (শরীরে বহনযোগ্য ক্যামেরা) রয়েছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্টদের কাছে। দায়িত্বরত সার্জেন্টরা কখন কী করছেন, তা ক্যামেরায় রেকর্ড থাকার কথা। এতে দায়িত্বে যেমন ফাঁকি দেওয়া যায় না, তেমনি অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ালে থাকার কথা ভয়ে; কিন্তু এই বডিওর্ন ক্যামেরা বডিতে থাকলেও তা কোনো কাজে আসছে না। এই ক্যামেরার সংযোগ কেন্দ্রীয় সার্ভারে যুক্ত থাকার কথা থাকলেও তা নেই।
বডিওর্ন ক্যামেরা কাজে না আসার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, দায়িত্বরত সার্জেন্টরা এসব ক্যামেরা বডিতে ঝুলিয়ে রাখলেও তা অন করতে বা চালু রাখতে অনীহা দেখাচ্ছেন। শুধু কোনো চালক বা পথচারীকে ‘ঘায়েল’ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্যামেরা। অনেক সময় তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। নিজেরা কী করছেন, তা দেখা যায় না তাতে। তবে ভিন্ন কথা বলছেন দায়িত্বরত সার্জেন্টরা। তাদের দাবি, তাদের কাছে ক্যামেরা থাকলেও তাতে ব্যাটারির চার্জ থাকে না। এ জন্য তারা তা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারেন না।
সড়কে প্রায়ই যানবাহন চালক, পথচারী ও ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। আইন অমান্য করেন পথচারী ও যানবাহন চালকরা। আবার কখনো পুলিশ সদস্যদের খারাপ আচরণের অভিযোগ ওঠে। এসব বিষয় মনিটরের জন্য ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ১৫টি বডিওর্ন ক্যামেরা দিয়ে যাত্রা শুরু করে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। ধীরে ধীরে প্রায় সব ট্রাফিক সার্জেন্টকে জন্য ক্যামেরা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, বডিওর্ন ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করা হবে কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুম থেকে। সেখান থেকে ক্যামেরার সঙ্গে থাকা ‘বিল্ট ইন গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের’ মাধ্যমে পুলিশ সদস্যের অবস্থান শনাক্ত করা যাবে। এ ছাড়াও ক্যামেরায় ধারণ করা যাবতীয় তথ্য সরাসরি কেন্দ্রীয় সার্ভারে চলে যাবে। এতে নজরদারির মাধ্যমে ট্রাফিক পুলিশদের কাজের স্বচ্ছতার পাশাপাশি জবাবদিহিও নিশ্চিত করা হবে। তবে প্রায় ৯ বছরও কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে এই ক্যামেরা যুক্ত করা যায়নি। এখন বডিতে ক্যামেরা থাকলেও তা ঠিকঠাক ব্যবহার হয় না।
সাবেক আইজিপি এ কে এম শহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, পুলিশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ডিভাইস চালু করা হলো, তার চাবিকাঠি যদি পুলিশের হাতেই থাকে, তবে জনগণের সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পুলিশের যেখানে প্রয়োজন সে ক্যামেরা ব্যবহার করে ভিডিও ধারণ করবে; কিন্তু যখন সে অনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত হবে তখন স্বাভাবিকভাবেই ক্যামেরা বন্ধ রাখবেন। এভাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, এটি সরকারের টাকার অপচয়। উন্নত দেশের মতো রাস্তায় রাস্তায় আধুনিক ক্যামেরা স্থাপন করে সরাসরি কেন্দ্রীয় সার্ভার থেকে পর্যবেক্ষণ করলেই সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে মত দেন সাবেক এই পুলিশ প্রধান।
রাজধানীর কয়েকটি ট্রাফিক সিগন্যাল ঘুরে দেখা গেছে, দায়িত্বরত অধিকাংশ পুলিশ সার্জেন্টের পোশাকে বডিওর্ন ক্যামেরা রয়েছে; কিন্তু ক্যামেরাটি সার্বক্ষণিক চালু থাকার কথা থাকলেও তাদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে ভিন্ন চিত্র। দায়িত্বরত একাধিক সার্জেন্ট কালবেলাকে জানান, অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলেই কেবল তারা ক্যামেরা অন করে ভিডিও ধারণ করেন। বাকি সময় ক্যামেরা বন্ধই থাকে।
রাজধানীর মতিঝিল ট্রাফিক বিভাগে দায়িত্ব পালন করা একজন সার্জেন্ট কালবেলাকে বলেন, ক্যামেরার ডিভাইসটিতে একবার চার্জ দিলে আট ঘণ্টা সচল থাকার কথা; কিন্তু ক্যামেরা তিন থেকে চার ঘণ্টার বেশি সার্ভিস দেয় না। এ জন্য অনেক সময় বিশেষ প্রয়োজন হলেও ক্যামেরা ব্যবহার করা যায় না।
লালবাগ ট্রাফিক বিভাগের অধীন একটি সিগন্যালে কর্মরত অন্য এক সার্জেন্ট বলেন, ‘আমার বডিওর্ন ক্যামেরাটি পুরোনো মডেলের। ক্যামেরা অন করলে আধা ঘণ্টাও চার্জ থাকে না। নির্দেশনা থাকায় ঝুলিয়ে রাখি। দরকারে ব্যবহার করা যায় না।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার সাহেদ আল মাসুদ কালবেলাকে বলেন, ‘ট্রাফিক সার্জেন্টদের সার্বক্ষণিক বডিওর্ন ক্যামেরা চালু রাখার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া আছে। এর পরেও কেউ যদি বডিওর্ন ক্যামেরা বন্ধ রাখেন, তাহলে তারা নিজেরাই বিপদে পড়বেন। যখন কোনো মানুষ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে, তখন তারা ভিডিও দেখাতে না পারলে দোষী বলে গণ্য হবেন। তবে আমরা সবাইকে বডিওর্ন ক্যামেরার আওতায় আনার চেষ্টা করছি।’
তবে বডিওর্ন ক্যামেরা বন্ধ রাখার ব্যাপারে ট্রাফিক পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালবেলাকে বলেন, ডিভাইসে চার্জ না থাকার বিষয়টি আংশিক সত্য হলেও ক্যামেরা বন্ধ রাখার পেছনে এটিই একমাত্র কারণ নয়। অধিকাংশ পুলিশ সদস্যই ক্যামেরা ব্যবহার না করে দীর্ঘদিন ফেলে রাখার কারণে অনেকের ক্যামেরার ব্যাটারি দুর্বল হয়ে যায়। বডিওর্ন ক্যামেরা থাকলে একজন কর্মকর্তাকে সবসময় আইনি বিধিবিধান ও নিয়মের মধ্য দিয়ে চলতে হয়। এ জন্য পুলিশ কর্মকর্তা বডিওর্ন ক্যামেরা বন্ধ রাখতে বেশি উৎসাহী।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পুলিশের এ ডিভাইসটি একটি সাধারণ ক্যামেরার মতোই। এখানে কোনা নেটওয়ার্ক সংযোগ বা জিপিএস সিস্টেম নেই। ফলে দায়িত্বরত কোনো পুলিশ কর্মকর্তা ক্যামেরা চালু রাখছেন, নাকি বন্ধ রাখছেন তা মনিটর করা যায় না। তারা ক্যামেরা চালু থাকলেও এ মুহূর্তে কে কি করছেন তাও দেখার সুযোগ নেই। তবে ডিভাইসটি চালু করলে ভিডিও-অডিও রেকর্ড থাকে, যা পরে প্রয়োজন হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পর্যবেক্ষণ করেন।