দুলাল হোসেন
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৩:২৫ এএম
অনলাইন সংস্করণ

বিএনসিএমআরসি : কাজই শুরু হয়নি, শেষ হচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদ

বিএনসিএমআরসি : কাজই শুরু হয়নি, শেষ হচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদ

বঙ্গমাতা ন্যাশনাল সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার রিসার্চ সেন্টার (বিএনসিএমআরসি) স্থাপন প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটির ৫ বছর মেয়াদ শেষ হবে আগামী জুনে। অথচ শুরু হয়নি নির্মাণকাজ। উল্টো এখন চলছে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর জন্য সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) গঠনের প্রক্রিয়া। সংশোধিত প্রস্তাবে ১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকার প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে ৩ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে বলে জানা গেছে।

রাজধানীর মহাখালী সাততলা বস্তি এলাকায় ১৬ তলা ভবন নির্মাণ হওয়ার কথা। তবে সেই জায়গাও এখনো খালি করা হয়নি। কবে জায়গা খালি হবে, কবে নাগাদ ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হবে—খোদ প্রকল্প পরিচালকও জানেন না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর জন্য ডিপিপি সংশোধনের পর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক)। অনুমোদন মিললে নির্মাণকাজ শুরু হবে। জায়গা খালি না হলে আবারও বিলম্ব হতে পারে নির্মাণকাজে।

প্রকল্পটির উদ্দেশ্য দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে চিকিৎসা জীবপ্রযুক্তিবিষয়ক আন্তর্জাতিকমানের সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন গবেষণাগার স্থাপন এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে নতুন নতুন গবেষক তৈরি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে দেশের চিকিৎসা গবেষণা উন্নত বিশ্বের সমপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ও রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে মানুষের চিকিৎসাসেবা প্রদানে সহায়তা করার ক্ষেত্রে এই রিসার্চ সেন্টার ভূমিকা রাখবে। এই গবেষণাগারে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের জেনেটিক প্যাটার্ন এবং এ সম্পর্কিত গবেষণা চালানো যাবে। দেশের মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজনে রোগ, রোগীর তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণা এবং আধুনিক জীবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের ওষুধ ও খাদ্য শিল্পের উন্নয়নে সহায়তা করাই হবে এই সেন্টারের কাজ।

২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মুহাম্মদ দিলোয়ার বখতের সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, এতে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনই নেই। অথচ ২৫ কোটি টাকার ওপরের প্রকল্প হলেই সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

জানা গেছে, ডিপিপিতে গবেষণাগার নির্মাণের কথা বলা হলেও এতে কী কী সুবিধা থাকবে এবং দেশের মানুষের কী উপকার হবে, তার কোনো বর্ণনা নেই। পরামর্শক বাবদ ৪৯ কোটি টাকা ধরা হলেও কী বিষয়ে, কতজন পরামর্শক, কত সময়ের জন্য নিয়োগ করা হবে এবং তাদের যোগ্যতাই–বা কী হবে, এ ব্যাপারেও কিছু বলা নেই। যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য জনবল নিয়োগেরও প্রস্তাব নেই। প্রশ্ন উঠার পরে দায়সারা একটি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন পিইসিতে জমা দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনসিএমআরসির প্রকল্প পরিচালক ডা. হাসিবুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশে গাছপালা, পশুপাখির গবেষণার জন্য রিসার্চ সেন্টার আছে, অথচ মানুষের জন্য কোনো রিসার্চ সেন্টার নেই। আমরা কতটা অবেহলিত প্রাণী। টাকা আছে অথচ আমাদের রিসার্চ ল্যাবরেটরি নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রিসার্চ সেন্টার বাড়ানোর বিষয়ে তাগিদ দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী একটি হিউম্যান রিসার্চ ল্যাব তৈরি করতে বলেছেন। এটি করার মতো দেশে কোনো অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান নেই। তাই বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

কাজ শুরু না হওয়ার বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, এতদিন কাজ হয়নি। প্রকল্পের নির্মাণ হবে মহাখালী সাততলা বস্তি এলাকায়। সেখানকার বস্তি এখনো উচ্ছেদ করা হয়নি। ফলে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়নি। রাজনৈতিক ঝামেলাও আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে। কারণ সব কিছুর দাম তো বেড়েছে। ২০১৬ সালে যখন এই প্রকল্পের ইস্টিমেট করি তখন ১ ডলারের দাম ছিল ৬০-৬৫ টাকা। সেই হিসাবে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় দেড় হাজার কোটি টাকা। এখন তো ডলারের দাম ১০৫ টাকা। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এসেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আমাদের একটি ভ্যাকসিন রিসার্চ সেন্টার থাকতে হবে। সেটি এই রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধীনে হবে। তার খরচও এর সঙ্গে যোগ হবে। আমাদের হিসাবে সবমিলিয়ে এই প্রকল্পের ব্যয় ৫ হাজার কোটি টাকা হওয়া উচিত। আমাদের যে কনসালট্যান্ট টিম আছে, তারা হিসাব না করলে খরচ বলা যাবে না। তবে প্রকল্পের ব্যয় ৩ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে। কনসালট্যান্ট টিমের প্রতিবেদন আগামী মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে পেয়ে যাব। ইস্টিমেট পাওয়ার পর আরডিপিপি একনেকে পাঠানো হবে। একনেক যেটুকু অনুমোদন করে দেবে, সেটা হবে প্রকল্পের মূল বাজেট।

প্রকল্পের জায়গা থেকে বস্তি উচ্ছেদের বিষয়ে ডা. হাসিবুল ইসলাম বলেন, বস্তি উচ্ছেদের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয় বস্তি উচ্ছেদ করে দেওয়ার পর, সেখানে নির্মাণকাজ শুরু করা যাবে। মন্ত্রণালয়ও পজিটিভ জায়গা খালি করার ব্যাপারে। কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে। দলিল আমাদের নামে, কেন উচ্ছেদ আটকে আছে, তা আমি জানি না। তবে জায়গা খালি করার জন্য বারবার নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। তারা জায়গা খালি করছে না। আমার মনে হয় জায়গা খালি করা নিয়ে পলিটিক্যালি কোনো ইস্যু আছে।

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাস্তবায়ন বিলম্ব হওয়ায় এ ভবনের (বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল-বিএমআরসি) একটি ফ্লোরে অন্তর্বর্তী ল্যাব স্থাপনের কাজ চলছে। ছোটখাটো রিসার্চসহ আমাদের জরুরি কাজগুলো এখানে করা যাবে। আগের প্রকল্প পরিচালক দায়িত্ব পালন এই ল্যাবের জন্য ১১ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনেছেন। যন্ত্রপাতি ক্রয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া বা দাম নিয়ে আমি কোনো কথা বলব না, তবে যেসব যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে, তা আমাদের কাজে লাগবে।

প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী কালবেলাকে বলেন, বঙ্গমাতা ন্যাশনাল সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার রিসার্চ সেন্টার চালুর বিষয়ে একাধিকবার মিটিং হয়েছে। এখন এটি স্থবির হয়ে আছে। এটা কী হচ্ছে না, আদৌ হবে কিনা তা নিশ্চিত করছে না। আন্তর্জাতিকমানের এই ল্যাবরেটরিটি দ্রুত করা দরকার।

জানা গেছে, প্রকল্পের নির্মাণ শুরু না হওয়ায় বিএমআরসি একটি অন্তর্বর্তীকালীন ল্যাব প্রতিষ্ঠানের প্রক্রিয়া শুরু করে। পরে ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি প্রকল্পটির অধীন একটি ল্যাব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পাঁচটি প্যাকেজে ৫১ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু কোনো দরপত্র বিক্রি না করেই সেই দরপত্র আহ্বান বাতিল করে একই বছরের ১ এপ্রিল পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়। আন্তর্জাতিক দরপত্র জমা দেওয়ার জন্য অন্তত ৪২ দিন সময় দেওয়ার কথা থাকলেও পুনঃদরপত্রের অজুহাতে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত ২৮ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে সময় কমিয়ে দেওয়ায় মাত্র দু-তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে থেকে খুবই দ্রুততার সঙ্গে সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রিচম্যান প্রাইভেট লিমিটেডকে নির্বাচিত করা হয়। অথচ রিচম্যানের থেকে একটিতে প্রায় ৪ কোটি, আরেকটিতে ৩ কোটি টাকা কম দর দিয়েও কাজ পায়নি অন্য একটি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্প পরিচালক নিজ ক্ষমতাবলে রিচম্যানকে ১১ কোটি টাকার তিনটি কার্যাদেশ দেন। বাকি দুটি প্যাকেজে ৪০টি কোটি টাকার কার্যাদেশের অনুমোদন প্রকল্প পরিচালকের এখতিয়ারে বাইরে থাকায় সেগুলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়।

সর্বোচ্চ দরদাতা না হয়েও রিচম্যান কেন কাজ পেয়েছে? অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পটির প্রকল্প পরিচালক ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা এক সময় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) একটি প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। নিটোর (পঙ্গু হাসপাতাল) কাজ করেছে রিচম্যান। সেই সূত্রে প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে তাদের সখ্য বা আস্থার সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হাতি শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে আছাড় মারল কৃষককে

বাবার বাড়ি যাওয়ায় স্ত্রীকে ২৭টি কোপ দিলো স্বামী

সিলেটে ট্রাক-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২

ব্যারিস্টার খোকনের দলীয় পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি 

বাড়ি ফেরা হলো না বাবা-ছেলের

বাংলাদেশের দাবদাহ নিয়ে যা বলছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম

অনুষ্ঠিত হলো বিইউএইচএস -এর প্রথম সমাবর্তন

ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে : ম্যাখোঁ

ছেলেদের দোষে ডুবছেন মাহাথির মোহাম্মদ

হিজাব আইন না মানায় ইরানে ব্যাপক ধরপাকড়

১০

তীব্র তাপপ্রবাহে বৃষ্টি চেয়ে হাজারো মুসল্লির কান্না

১১

মানব পাচারের দায়ে একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

১২

ঝিনাইদহে স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর যাবজ্জীবন

১৩

কারিগরির ফাঁকা সনদ মিলল তোষকের নিচে, গ্রেপ্তার কম্পিউটার অপারেটর

১৪

ঝিনাইদহে বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায়

১৫

ভোট দিলে যে শহরে মিলবে ফ্রি বিয়ার, ট্যাক্সিসহ নানা সুবিধা

১৬

কুমিল্লায় পানিতে ডুবে ৪ শিশুর মৃত্যু

১৭

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ফখরুলের সাক্ষাৎ

১৮

চট্টগ্রামে জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার বাঘা শরীফ

১৯

সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরলেন শিক্ষামন্ত্রী 

২০
*/ ?>
X