
দেশে কাঙ্ক্ষিত আয়ের পথ খুঁজে না পেয়ে তরুণদের অনেকেই যে কোনো উপায়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে মরিয়া। স্বপ্ন পূরণে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতেও পিছপা হচ্ছেন না তারা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার জন্য অবৈধ প্রক্রিয়ায় সমুদ্রপথে অনিশ্চিত যাত্রা করছে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের পর কেউ কেউ লক্ষ্যে পৌঁছলেও, প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা। তা সত্ত্বেও বেড়েই চলেছে অবৈধপথে বিদেশ যাত্রা। দেশে ভবিষ্যৎ গড়া নিয়ে অনিশ্চয়তার সুযোগে পাচারকারীরা জীবন নিয়ে জুয়ায় মেতে উঠেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ইউরোপিয়ান বর্ডার অ্যান্ড কোস্ট গার্ড এজেন্সি-ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী আসছে। তার মধ্যে বাংলাদেশিও রয়েছে। বিশেষ করে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাচ্ছেন হাজার হাজার বাংলাদেশি। এভাবে যেতে গিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ট্রলারডুবি হচ্ছে। ইউরোপের জেলে বন্দি রয়েছেন অনেকে। কেউবা গ্রেপ্তার হচ্ছেন তুরস্কে।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাগরপথে ইতালিতে আসা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এ প্রক্রিয়ায় ইতালিতে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ ২২ শতাংশ মিশরীয়। এরপর তিউনিসীয় ২০ শতাংশ ও বাংলাদেশি ১৫ শতাংশ।
সংস্থাটির তথ্য মতে, ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ২১ লাখ মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এই প্রক্রিয়ায় ইউরোপে যাওয়ার পথে মারা গেছেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। এদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশিও রয়েছেন। গত এক দশকে এভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় আটক হয়েছেন ৫৫ হাজার বাংলাদেশি।
ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরীফুল হাসান বলেন, ‘যেসব দেশ থেকে বেশি মানুষ অবৈধ পথে ইউরোপ যাচ্ছেন সেসব দেশের তালিকা দেখলে বোঝা যাবে, বাংলাদেশ ছাড়া বাকি দেশগুলো হয় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে আছে অথবা ওইসব দেশে দুর্ভিক্ষ কিংবা যুদ্ধ চলছে। বাংলাদেশে কিন্তু এ ধরনের সংকট নেই। এদেশ থেকে যারা অবৈধভাবে ইউরোপে যাচ্ছেন, তারা কিন্তু দালালদের কয়েক লাখ টাকা দিচ্ছেন। এই টাকা দিয়ে দেশেই কোনো ব্যবসা করা সম্ভব হতো। তার মানে হলো, তাদের বিদেশে যাওয়ার কারণ অভাব বা টাকার সমস্যা নয়। এখানে একটা মানসিক ও সামাজিক চাপের বিষয় রয়েছে। ইউরোপে যাওয়া অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো। সেই স্বপ্ন পূরণে তারা বিপদের সামনে দাঁড়াতেও পিছপা হচ্ছে না।’
ইতালি অভিবাসী ২৭৯ জন বাংলাদেশি নাগরিক ও ৯২টি পরিবারের ওপর সমীক্ষা চালিয়েছে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ)। এতে দেখা যায়, ইতালিতে যাওয়ার জন্য ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া বাংলাদেশিদের ৭৯ শতাংশই জীবনের ঝুঁকি সম্পর্কে জানেন। তা সত্ত্বেও নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তারা এই ঝুঁকি নিয়েছেন। নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা, আর্থিক অসচ্ছলতা এবং ঋণ পরিশোধের চাপে অনেকটা বাধ্য হয়েই লিবিয়া উপকূল দিয়ে ইতালিতে পাচার হয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। এদের মধ্যে ৯৬ দশমিক ৭ শতাংশ অভিবাসী ভূমধ্যসাগরের কেন্দ্রস্থলের পথ ব্যবহার করে লিবিয়া উপকূল হয়ে ইতালি যায়।
এ সমীক্ষা অনুযায়ী, ৮১ শতাংশ বাংলাদেশি লিবিয়ায় কাজের উদ্দেশে যাত্রা করলেও তাদের জোর করে সমুদ্রপথে ইতালি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে ১৬ শতাংশ অভিবাসীকে সুদান অথবা মিশরে কাজের কথা বলে নেওয়া হলেও লিবিয়া উপকূল দিয়ে ইতালি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ গবেষণায় বলা হয়, ইতালিতে অভিবাসনের পুরো প্রক্রিয়া লিবিয়ার সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যারা স্থানীয় সন্ত্রাসী এবং পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করে চলে। ৭৯ দশমিক ৭ শতাংশ অভিবাসীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। যাওয়ার পথে ১ দশমিক ৪ শতাংশ যৌন নির্যাতনের স্বীকার হন।
বিভিন্ন দেশে অভিবাসী ও অভিবাসন প্রত্যাশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার জন্য বর্তমানে ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে দালালরা। শুধু লিবিয়া থেকে ইতালি পৌঁছানোর জন্য ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতেই একেকজন অভিবাসনপ্রত্যাশীর খরচ হচ্ছে আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ টাকা।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ শরীফুল হাসানের মতে, অভিবাসনপ্রত্যাশী ব্যক্তি ও তার পরিবার সবকিছু জানার পরও দালালের হাতে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে দিচ্ছে। অনেকটা জেনেবুঝেই জীবন নিয়ে জুয়া খেলছেন তারা। অথচ বিদেশগামী ও তাদের পরিবার দায়িত্বশীল ও সচেতন হলে মানবপাচার অনেকটাই রোধ করা সম্ভব।
ওকাপের চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশের একক চেষ্টায় মানব পাচারের এ প্রবণতা রোধ করা সম্ভব নয়। কারণ এটি একটি আন্তঃদেশীয় অপরাধ। দেশের মধ্যে সক্রিয় দালালরা ছাড়াও যে রুটে পাচার হয় সে দেশের এক বা একাধিক চক্র এতে ভূমিকা রাখে। সেইসঙ্গে ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও পাচারকারীদের সহযোগী রয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিকভাবেই এই সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে।
তিনি বলেন, এ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশের মধ্যেও দালালদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে উদাহরণ সৃষ্টি করা জরুরি। কিন্তু দেশে কঠোর আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। এখন পর্যন্ত শাস্তির এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই, যা দেখে দালালরা ভয় পাবে।
পাচার রোধ করে নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, ‘দেশে বাংলাদেশে মানব পাচারের বিরূদ্ধে আইনি ব্যবস্থা আরও জোরদার হয়েছে। নিরাপদ, নিয়মিত, সুষ্ঠু ও দায়িত্বশীল শ্রম অভিবাসন নিশ্চিত করার জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যেসব বিচ্যুতি রয়েছে সেগুলো দূর করা চেষ্টা চলেছে।’