নদীমাতৃক এই দেশে নৌযানের সঠিক হিসাব হয়নি এখনো। সরকারের খাতায় দেশজুড়ে এই যানের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার; কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিসাবের বাইরে আছে ২ লাখেরও বেশি! অধিকাংশ নৌযান অনিবন্ধিত হওয়ায় আসছে না নৌপথে শৃঙ্খলা, রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছেন সরকার।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে দেশে নদনদীর সংখ্যা চার শতাধিক। এর বাইরে হাওর অধ্যুষিত জেলা সাতটি। সেখানকার বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের সংশ্লিষ্টরাই মনে করেন, সাত জেলায় যাত্রীবাহী নৌযানের সংখ্যা অন্তত ২০ হাজার। হাওর, নদনদী ও উপকূলের বাইরে রয়েছে এমন সামুদ্রিক নৌযানের সংখ্যাও কম নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার উল্লিখিত নৌযানের সংখ্যা মোটেও সঠিক নয়। নৌপরিবহন অধিদপ্তর সূত্রগুলো বলছে, নৌযান জরিপের জন্য বেশ কয়েকবার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হলেও কাজ হয়নি। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সব নৌযান রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনতে বড় প্রকল্প প্রয়োজন। বাজেটের অভাবে এ উদ্যোগ থেমে আছে। বড় ধরনের কোনো নৌ দুর্ঘটনা ঘটলেই প্রশ্ন ওঠে দুর্ঘটনাকবলিত যানটি কি বৈধ ছিল? ওই রুটে চলাচলের অনুমতি ছিল কিনা, এমন প্রশ্নও ওঠে। সর্বশেষ গত ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীতে তীর্থযাত্রীবোঝাই নৌকাডুবির পরও এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। নৌকাটি অবৈধ ছিল বলে দুর্ঘটনা তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে। এর আগেও কমবেশি প্রতিটি দুর্ঘটনায় নৌযানের বৈধতা, রেজিস্ট্রেশন না থাকাসহ বিভিন্ন ত্রুটির বিষয় তদন্তে উঠে আসে। তাই জোরালো প্রশ্ন উঠেছে, দেশে এমন অবৈধ নৌযানের সংখ্যা প্রকৃত অর্থে কত? অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌপথে চলাচলকারী নৌযানের পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোতে নেই। শুধু নিবন্ধিত নৌযানের তথ্য সংরক্ষণ করে নৌপরিবহন অধিদপ্তর।
গত ৮ নভেম্বর নৌযান সার্ভে সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী স্বাক্ষরিত চিঠি ৪৩টি বিভাগ ও ব্যক্তিকে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়েছে, ‘অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ ১৯৭৬ এবং এর সংশোধনী ২০০৫’র ধারা ১৯ এবং অভ্যন্তরীণ ইস্পাত নির্মিত জাহাজগুলোর নির্মাণ বিধিমালা, ২০০১-এর প্রারম্ভিক সার্ভে বিধি ২৫৬ (২) মোতাবেক কোনো নৌযানের অনুকূলে প্রদত্ত রেজিস্ট্রেশন নম্বর ওই নৌযানের গায়ে স্থায়ীভাবে লেখা বাধ্যতামূলক। এ বিধান যথাযথভাবে অনুসরণের জন্য সব নৌযানের পোর্ট সাইড, স্টারবোর্ড সাইডের বাইরে ও পেছনে নিম্নবর্ণিত উপায়ে ওয়েল্ডিং করে রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখতে হবে।... এই পত্র জারির তারিখ থেকে সব নতুন ও বাৎসরিক সার্ভের জন্য আগত নৌযানের ক্ষেত্রে এ আদেশ প্রযোজ্য হবে। সব মালিকের তাদের নৌযানকে সার্ভের নিমিত্তে উপস্থাপন করার পূর্বে ...রেজিস্ট্রেশন নম্বর সংযুক্ত করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজ্ঞপ্তিতে দেশের সব নৌযান নিবন্ধনের আওতায় আনা সম্ভব হবে না। এটি অধিদপ্তরের রুটিন কাজ। এজন্য দেশব্যাপী মাঠপর্যায়ে কর্মসূচি পালনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। নৌশুমারির বিষয়ে জানতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. নিজামুল হকের টেলিফোন নম্বরে ফোন দিলে কেউ রিসিভ করেননি। প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রকৌশলী ও প্রধান সার্ভেয়ার মো. মনজুরুল কবীরের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্র মতে, বৈধর চেয়ে অবৈধ নৌযানের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। বিশেষজ্ঞ ও নৌখাত নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের দাবি, এতে নৌ নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে। সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে এবং মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
নৌ চলাচল খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ১৪ হাজার ৮০৫। এর মধ্যে লঞ্চ ও ট্রলারসহ যাত্রীবাহী অন্য নৌযান ৮৪৭, ইঞ্জিনচালিত যাত্রীবাহী নৌকা ৪২২ এবং স্পিডবোট ৭৭৮টি। মালবাহী ৩ হাজার ৫৯১, বালুবাহী ৫ হাজার ৩৩৬, ড্রেজার ১ হাজার ৫২৮, পণ্যবাহী ১ হাজার ১৬, বার্জ ৫০৩, টাগবোট ১৬৩ট ও ফেরি ৪৪টি। বাকিগুলো অন্যান্য নৌযান। সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ১৫ হাজার ৬৯০। তবে এ তথ্যের সঙ্গে একই সংস্থার সাবেক দুই মহাপরিচালকের (ডিজি) দ্বিমত রয়েছে। নৌ অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি কমডোর যোবায়ের আহমেদ বলেছেন, অনিবন্ধিত প্রায় ২ লাখ অবৈধ নৌযান চলাচল করে। ডিজি থাকাকালে ‘হাউ টু প্রিভেন্ট লঞ্চ ডিজাস্টার?’ শীর্ষক এক সেমিনারে এ তথ্য প্রকাশ করেন তিনি।
এর আগে ২০১০ সালে একই অধিদপ্তরের তৎকালীন ডিজি রিয়ার অ্যাডমিরাল বজলুর রহমান নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর এক চিঠিতে উল্লেখ করেন, ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ খাতে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ১১ হাজার ৩০৮, এর মধ্যে নিয়মিত বার্ষিক সার্ভে হয় আনুমানিক ছয় হাজারের; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেশে যন্ত্রচালিত অভ্যন্তরীণ নৌযানের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। এই চিঠিতেও সরকারের রাজস্ব হারানো ও নৌ-দুর্ঘটনার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে বিদ্যমান নৌপরিবহন আইন ‘অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ (আইএসও)-১৯৭৬’-এর অধীনে প্রণীত বিধি এবং এ সংক্রান্ত দপ্তর আদেশ রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সর্বনিম্ন ১৬ হর্স পাওয়ার (অশ্বশক্তি) ক্ষমতাসম্পন্ন অথবা ১২ জনের অধিক যাত্রী ধারণক্ষমতার ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচলের জন্য নকশা অনুমোদন, নিবন্ধন ও সার্ভে (ফিটনেস) বাধ্যতামূলক।
সম্প্রতি পঞ্চগড়ে ডুবে যাওয়া নৌকাটি যন্ত্রচালিত ছিল। এর আয়তন ছিল ১২ জনের অনেক বেশি যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন; কিন্তু প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, ইঞ্জিন, নিবন্ধন ও ফিটনেস ছিল না। ফলে চলাচলের জন্য রুট পারমিট এবং নদী ও নৌপথ নির্ধারিত ছিল না। সুতরাং, আইনের দৃষ্টিতে নৌকাটি ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মীর তারেক আলী বলেন, ‘বহু আগে থেকেই নৌযানের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সরকারের হাতেও সঠিক সংখ্যা নেই। তবে নিবন্ধিতের চেয়ে অনিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা অনেক বেশি হবে।’ নৌশুমারি করে এর সঠিক পরিসংখ্যান তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘এতে অভ্যন্তরীণ দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমবে এবং রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।’
পরিবেশ ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক বেসরকারি সংগঠন গ্রিন ক্লাব অব বাংলাদেশের (জিসিবি) সভাপতি নুরুর রহমান সেলিম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নিজেই যেখানে নৌ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে আন্তরিক ও সচেষ্ট, সেখানে হাজার হাজার অবৈধ নৌযান চলাচল করবে, দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটবে, তা মেনে নেওয়া যায় না।’ নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে অবিলম্বে নৌশুমারি শুরুর তাগিদ দেন তিনি।