রীতা ভৌমিক
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০২:৫৯ এএম
অনলাইন সংস্করণ

ভাষা আন্দোলন : অবহেলায় হারিয়ে গেছে স্মৃতিবিজড়িত আমতলা

ভাষা আন্দোলন : অবহেলায় হারিয়ে গেছে স্মৃতিবিজড়িত আমতলা

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হলো। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আমগাছটি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর সংগ্রহশালায় সংগৃহীত। ভাষা আন্দোলন পরিষদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আমগাছটি ডাকসু সংগ্রহশালায় হস্তান্তর করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে ঐতিহাসিক আমতলার খোলা চত্বর আর নেই। দালান-কোঠার ভিড়ে চাপা পড়ে গেছে সেই ঐতিহাসিক স্থান। ঐতিহাসিক আমতলার সেই জায়গাটি সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষের নেই কোনো উদ্যোগ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পশ্চিম দিকে পকেট গেটে ছিল ঐতিহাসিক আমগাছটির অবস্থান। সে সময়ে এ স্থানে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন। আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অস্থায়ী ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ক্যাম্পটি ছিল মধুর রেস্তোরাঁ। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আলোচনায় মুখরিত হয়ে উঠত মধুর ক্যান্টিন।

‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র পক্ষ থেকে ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি-না, সে বিষয়ে একটি সভা আহ্বান করা হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ভোট দেন আব্দুল মতিন, গোলাম মাওলা, শামসুল আলম ও অলি আহাদ। ২১ ফেব্রুয়ারি সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। সকাল ১১টার দিকে দলে দলে ছাত্ররা সভায় অংশ নেওয়ার জন্য আমগাছের গোড়ায় সভাস্থলে জড় হতে থাকেন। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা মেয়েদের কলেজ ও বিদ্যালয়ে গিয়ে মেয়েদের আমতলার সভাস্থলে জড়ো হতে বলেন। সকাল ১১টা কী দুপুর ১২টার দিকে সভা শুরু হলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, যেহেতু ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে, সেহেতু ছাত্র এবং ছাত্রীরা চারজন বা আরও বেশি সংখ্যায় বিভক্ত হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবেন। পুলিশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত টের পেয়ে ফটকের সামনে ব্যারিকেড তৈরি করেন। সিদ্ধান্ত হয় পুলিশের তৎপরতাকে বানচাল করে দেওয়ার জন্য এবং গ্রেপ্তার এড়াতে ছাত্রীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে রাস্তায় নামবেন।

গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রছাত্রীরা মিছিল করে রাস্তায় নেমে পড়েন। প্রথম কয়েকটি ব্যাচ পুলিশের কর্ডন ভেদ করে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। প্রথম দলটির নেতৃত্ব দেন হাবিবুর রহমান শেলী। দ্বিতীয় দলের নেতৃত্ব দেন আবদুস সামাদ, তৃতীয় দলের নেতৃত্ব দেন ইব্রাহীম তাহা। সত্যাগ্রহীদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে ভ্যানে তুলতে থাকে। চতুর্থ দলের নেতৃত্ব দেন এস এ বারী। এরপর মেয়েদের একটি দল শাফিয়া খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া আহমেদ, শামসুন নাহার আর ইডেন কলেজের একজন ছাত্রী সত্যাগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয় ফটক দিয়ে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে মেয়েদের পুলিশের হাত থেকে উদ্ধারের সাহায্য করতে গেলে পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। টিয়ারশেলের গ্যাসে সারা বিশ্ববিদ্যালয় আচ্ছন্ন করে ফেলে। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য ছিল, তারা ইস্ট বেঙ্গল অ্যাসেম্বলি হল (বর্তমান জগন্নাথ হল) পর্যন্ত যাবেন। পুলিশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে ভ্যানে উঠিয়ে টঙ্গীর কাছে নিয়ে ছেড়ে দেয়। এই ঘটনার পরপরই ছাত্রজনতা পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ তাদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলের গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে সুফিয়া আহমেদসহ অনেকে আহত হন। মিছিল প্রতিরোধের জন্য শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপে এক বেদনাদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক পেরুতেই ছাত্ররা দলে দলে গ্রেপ্তার হয়। মাতৃভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত সেই স্থানের পকেট গেটের দেয়াল ঘেঁষে ডানদিকে নির্মাণ করা হয়েছে অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারদের বাথরুম।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক কালবেলাকে বলেন, ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের পক্ষ থেকে আমরা আবেদন করছি, তারা যেন এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সঙ্গে যেহেতু জায়গাটি যুক্ত আমরা চেষ্টা করি দিবস উপলক্ষে তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে। ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে সাজানো। জায়গাটিতে যাতে পবিত্রতা বজায় থাকে, এর চেষ্টা করি। এজন্য সমন্বিত প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম দরকার। যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা যদি বিষয়টি দেখেন, তাহলে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যোদ্ধা প্রতিভা মুৎসুদ্দী বলেন, ১৯৯৯ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা আমাদের জন্য বাঙালি জাতি হিসেবে অনেক গর্বের। যেখান থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতির দাবিতে আমরা লড়াই করেছি, প্রশাসনিকভাবে সেই আমতলা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। কারণ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই স্থানটিকে দেখে বলবে, এখান থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আমাদের পূর্ব প্রজন্ম লড়াই করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিজড়িত স্থান ঐতিহাসিক আমতলা সংরক্ষণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল উদ্যোগ নিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমরা সব ধরনের তথ্য দিয়ে, বিশেষায়িত জ্ঞান দিয়ে সহযোগিতা করব। জাতীয় জাদুঘরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রথম শহীদ মিনারের আলোকচিত্র অনুলিপি করার জন্য আনা হয়েছে।

পিয়ারু সরদারের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের এক রাতে যৌথ শ্রমে গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ—প্রথম শহীদ মিনার। ১৯৭১ সালে ২৬-২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে। সেই শহীদ মিনারের একাংশ অর্থাৎ একটি ভঙ্গুর পিলার জাতীয় জাদুঘরের দোতলায় সংরক্ষিত রয়েছে।

জাতীয় জাদুঘরের চলতি দায়িত্ব ইতিহাস বিভাগের কিপার এ কে এম সাইফুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আমতলার কোনো স্মৃতি আমাদের সংগ্রহশালায় সংগৃহীত নেই। তবে ভাষা আন্দোলন পরিষদের সৌজন্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে ভোট দাতা অলি আহাদ, গোলাম মাওলা, আব্দুল মতিন ও শামসুল আলমের আলোকচিত্র আমাদের কাছে সংগৃহীত রয়েছে।

১৯৫২-এর প্রথম শহীদ মিনারের আলোকচিত্র থেকে আরেকটি অনুলিপি করার প্রস্তাব আমরা পেয়েছি। এটা নিয়ে পরবর্তী সময়ে কাজ করার উদ্যোগ আমরা নিয়েছি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সমুদ্র সৈকতে ভয়ংকর বিষধর সাপ, আতঙ্ক

রাজধানীর যে ২০ স্থানে বসছে পশুর হাট

শ্রম পরিবেশ উন্নয়নে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন আইন

‘দ্য ওয়ার্ল্ড স্কলার্স কাপ ২০২৪’ / শুরু হলো জমজমাট বুদ্ধির লড়াই!

পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে চাকরি, পদসংখ্যা ৫৪

‘সবসময় স্বপ্ন ছিল চেন্নাইয়ের হয়ে খেলার’

কুবিতে উপাচার্য, ট্রেজারার ও প্রক্টরের কার্যালয়ে তালা

ভিত্তিহীন মেইলে সমর্থন প্রত্যাহার / মামলায় জিতলেন লেবার পার্টির প্রার্থী নুরুল খান

চবির হলে ছাত্রলীগ কর্মীর মদপান, ছবি ভাইরাল

কুড়িগ্রামে হিটস্ট্রোকে এক নারীর মৃত্যু

১০

গাজীপুরে বিদ্যুতের সাবস্টেশনের ট্রান্সফরমারে আগুন

১১

বেলুন উড়িয়ে শুরু হলো জব্বারের বলী খেলা

১২

২৮ এপ্রিল খুলছে স্কুল-কলেজ

১৩

নারী শিক্ষার উন্নয়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে : জিল্লুর রহমান

১৪

জিআই সনদ পেল টাঙ্গাইল শাড়িসহ ১৪ পণ্য

১৫

মোনাজাতে অঝোরে চোখের পানি ফেললেন মুসল্লিরা

১৬

বাল্যবিয়ে রোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে : মানবাধিকারের চেয়ারম্যান 

১৭

সরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে ১৪ বিয়ে!

১৮

জেনারেল ম্যানেজার নিচ্ছে ল্যাবএইড, ৪৫ বছরেও আবেদন

১৯

নিজের নামে ভুয়া জিমেইল, সতর্ক করলেন ঢাবি উপাচার্য

২০
*/ ?>
X