
‘আমি নাটক থেকেই বেড়ে ওঠা মানুষ। তবে যখন কোনো প্ল্যাটফর্ম সুইচ করি, তখন সেই প্ল্যাটফর্মের ব্যস্ততা আমাকে অন্য প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে দেয় না। এখন সিনেমা যদি ওয়ার্ক করে, ফিল্মে যদি একটি জায়গা তৈরি হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই ফিল্ম নিয়ে থাকতে হবে। কারণ সবাই সিনেমার জন্য ডাকবেন’— নাটকে কাজ কমিয়ে দেওয়ার বিষয়য়ে এ কথাগুলোই বলছিলেন আফরান নিশো। মূলত ওটিটি ও সিনেমায় ব্যস্ত থাকার কারণেই গত এক-দুই বছর ধরে ছোট পর্দায় হাতেগোনা কাজ করেছেন। গত ঈদে আসেনি নতুন কোনো কাজ। শুধু নিশোই নন, জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, মেহজাবীন চৌধুরী, তানজিন তিশাসহ অনেকের ব্যস্ততাই এখন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ঘিরে। এর ফলে নাটকে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। বলা যায়, শিল্পী সংকটে পড়েছেন নাট্যনির্মাতারা। যদিও সেই শূন্যতা ধীরে ধীরে পূরণ হচ্ছে নবীনদের আগমনে। টেলিভিশন নাটকে চোখ রাখলেই দর্শকরা দেখতে পারছেন একঝাঁক নতুন অভিনয়শিল্পী। সম্ভাবনার একটা ক্ষেত্র তৈরি করেছেন তারা। সামনে আসছে জান্নাতুল সুমায়ই হিমি, ফারজানা আহসান মিহি, সামিরা খান মাহি, মাহিমা, রুকাইয়া জাহান চমক, আরশ খান, জাহের আলভি, সাদিয়া খান মাহী, মাহা, শ্রাবন্তী সেলিনাসহ বেশ কয়েকজন।
নতুনদের নিয়ে অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীর ভাষ্য, ‘ওটিটির কাজ করছি তাই ইদানীং নাটক করা হচ্ছে না। তবে যদি মনের মতো স্ক্রিপ্ট পাই তবে আবারও নাটক করব। আর আমাদের প্রত্যেকেরই তো একটা না একটা সময় জায়গা ছাড়তে হবে। এখন নতুন যারা কাজ করছে তাদের অনেকেই ভালো করছে। অনেকে চেষ্টা করছে। তাদের জন্য সবসময় আমার শুভকামনা থাকবে।’
তবে ইন্ডাস্ট্রিতে নতুনদের নিয়ে কাজ কেমন হচ্ছে? নিজেকে বিকশিত করতে তাদের সুযোগইবা কতটা? এসব বিষয়ে জানতে তারাবেলার কথা হয় নাটকের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ও তরুণ অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে।
অসংখ্য নাটকে লাইন প্রডিউসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মো. জিল্লুর রহমান জুয়েল। এ ছাড়া ডিভাইন মাল্টিমিডিয়া নামে তার একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। প্রযোজক জুয়েলের কাছে নতুনদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন কিছু টেলিভিশন চ্যানেল নতুনদের নিয়ে কাজ করছে। মেহজাবীন, নিশো—যারা একটু সিনিয়র, তারা তো ওটিটিতে কাজ করছেন, এদিকে সময় কম দিচ্ছেন। আর জুনিয়রদের মধ্যে এখন অনেকেই রয়েছেন, যারা নিশো-মেহজাবীনদের মতো এককভাবেই নাটকে কাজ করছেন। প্রশংসা পাওয়ার মতো কাজ করছেন।’
বর্তমান প্রজন্মের জনপ্রিয় অভিনেত্রী জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি। শুরুটা তার শিশুশিল্পী হিসেবে। ছোটবেলায় ধ্যান-জ্ঞান-সংগীত ঘিরে থাকলেও ২০১৪ থেকে তিনি পুরোদমে নাটকে কাজ করছেন। থিতু হয়েছেন অভিনয়েই। তরুণ প্রজন্মের কাছে তো নিলয়-হিমি জুটি এখন মুখে মুখে।
জানা গেছে, টেলিভিশন নাটকে আগের তুলনায় ব্যস্ততা বেড়েছে হিমির। বললেন, ‘প্রত্যেক শিল্পীরই কাজের সংখ্যা যখন বাড়তে থাকে তখন ব্যস্ততা একটু কমিয়ে দিয়ে বেছে বেছে এক্সক্লুসিভ কাজে মনোযোগী হওয়ার সময় আসে। সেই হিসেবে আমি বলব, নতুনদের জন্য অবশ্যই আগের চেয়ে সুযোগ বেড়েছে, যে কারণে আমরা এখন কাজ করতে পারছি। ব্যস্ততাও বাড়ছে। আমার কথা যদি ধরি, তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর কাজের পরিধি বেড়েছে।’
হিমির কথায় নতুনদের কাজের পরিধি বেড়েছে, তবে নাটকের গুণগত মানের কি পরিবর্তন হচ্ছে? ইন্ডাস্ট্রিতে বর্তমানে সেই পরিস্থিতি কেমন? এমন প্রশ্নে অভিনেত্রীর ভাষ্য, ‘আগে দেখা যেত চিত্রনাট্য হাতে পেয়েছি, আর শুটিংয়ে চলে যাচ্ছি! কিন্তু এখন একটা চিত্রনাট্য পেলে সেটা নিয়ে আগে ভাবি, সহশিল্পীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করি। কারণ কমেডি চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে গেলে আমাদের অনেক অবাস্তব বিষয়াদি নিয়ে কাজ করতে হয়, সেগুলো কতটা যৌক্তিক—এ বিষয়গুলো নিয়েও চিন্তা করি। আসলে প্রতিনিয়তই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি নিজের অভিনয়-দক্ষতা কীভাবে বাড়ানো যায়। লুক কিংবা চরিত্রাভিনেতার যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলো নিয়েও ভাবছি। প্রতিদিনই শেখার চেষ্টা করছি।’
টেলিভিশনের বাইরে নাটক নির্মাণে অন্যতম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আলফা আই। জানা গেছে, গত দুই মাসে প্রতিষ্ঠানটি ৫০টির মতো নাটক প্রযোজনা করেছে। যেখানে পুরোনোদের পাশাপাশি বেশিরভাগ কাজই করেছেন নতুন শিল্পীরা। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার শাহরিয়ার শাকিল বলেন, ‘আমরা সবসময় নতুন নির্মাতা ও শিল্পীদের প্রাধান্য দিই। পুরোনোরাও থাকেন। আফরান নিশো হয়তো নাটকে একেবারে কাজ করছেন না, তবে অপূর্বকে এখনো নতুন নাটকে পাওয়া যাচ্ছে। সাবিলা নূরও রয়েছেন। আমরা আসলে একসঙ্গে নতুন-পুরোনোদের নিয়ে কাজ করছি। তবে নাটকে নতুনদের সংখ্যাই বেশি।’
নাটকের দর্শকের কাছে দিন দিন জনপ্রিয়তা বাড়ছে অভিনেতা আরশ খানের। ‘ইনসাইড লাভ’, ‘দ্য ব্রেকআপ স্টোরি’, ‘প্রথম প্রেমের গল্প’—এমন কিছু উল্লেখযোগ্য নাটকে দেখা গেছে তাকে। এ অভিনেতার কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল—ছোট পর্দার অনেক অভিনয়শিল্পীই এখন ওটিটি কিংবা সিনেমায় ব্যস্ত থাকার কারণে নাটকে কম কাজ করছেন, এতে কি নাটকে নতুনদের জন্য সুযোগ বেড়েছে? আরশ বললেন, ‘নতুনরা হয়তো কাজ করছে তবে টেলিভিশন নাটক এখনো সিনিয়র শিল্পীদের ঘিরেই আছে। দর্শকদের কাছে আফরান নিশো-অপূর্ব ভাই কিংবা মেহজাবীন-তানজিন তিশা আপুদের নাটকগুলো যেভাবে পৌঁছেছে, এ সময়ে আমরা যারা অভিনয় করছি তাদের কাজগুলো সেভাবে পৌঁছাচ্ছে বলে মনে করি না আমি। আমার মনে হয়, আমাদের আরও একটু সময় লাগবে। তবে সিনিয়ররা এখন অতটা সময় দিচ্ছেন না নাটকে। এর ফলে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেখানে আমরা নতুনরা কাজের সুযোগ পাচ্ছি।’
দেশে নাটকের গুণগত মান পড়তির দিকে, যে কারণে দীর্ঘদিন ধরেই নাট্যনির্মাতারা বলে আসছেন নাটকের উন্নয়নে বাজেট বাড়ানোর বিকল্প নেই। তবে জানা গেছে, বাজেটের চিত্র এখনো আগের মতোই! যে কারণে নাটকের সংখ্যা বাড়ছে আর গুণগত মান কমছে। জানা যায়, নতুনদের নিয়ে একটি নাটক নির্মাণে বর্তমান ব্যয় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা, যা আগেও ছিল। ব্যতিক্রম শুধু তারাকা শিল্পীদের ক্ষেত্রে, তখন বাজেট কিছুটা বেড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা করা হয়।
তবে টিভি নাটকে এমন পরিবর্তনে দুটি বিষয়কে বেশ স্বস্তির বলে মনে করছেন সমালোচকরা। এতে করে যেমন নতুনরা পাচ্ছেন পর্যাপ্ত সুযোগ, তেমনি দর্শকদেরও একঘেঁয়েমি ভাব কমার অবকাশ তৈরি হয়েছে। নতুন মুখ ও জুটিতে এসেছে বৈচিত্র্যও।