
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সারা জীবনের মহৎ কীর্তি দিয়েই হয়ে উঠেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বলা যায় বাঙালির আকাশে উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের অন্য নাম বঙ্গবন্ধু। সবাই জানে এ তার নাম নয়, বাংলাকে ভালোবেসে, বাঙালিকে ভালোবেসে তিনি অতিক্রম করেছেন অনতিক্রম্য এ অসামান্য পরিচয়। ‘বঙ্গবন্ধু’—মাত্র এটুকু শব্দবন্ধের মধ্যেই কেমন অবলীলায় আকাশের অসীমতা আর সাগরের বিশালতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়! আবার সূর্যের প্রাখর্য এবং চাঁদের স্নিগ্ধতা—এ দুই বৈপরীত্যেরও অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে এই একটিমাত্র শব্দবন্ধের মধ্যে। কিন্তু কেন তিনি শ্রেষ্ঠ বাঙালি? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসের মধ্যে।
স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালির সুদীর্ঘকালের লড়াই-সংগ্রামের রক্তখচিত ইতিহাস এবং দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেমন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের গৌরবদীপ্ত অভ্যুদয়কে নিশ্চিত করেছে, একই সঙ্গে তা বাংলা সাহিত্যের ধারায় যুক্ত করেছে নতুন স্রোত, উন্মোচিত হয়েছে সাহিত্যের নতুন দিগন্ত। নাম তার মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য। কাব্যে-গল্পে-উপন্যাসে-সংগীতে-নাটকে শিল্পসুষমামণ্ডিত সৃজনশীলতার বেগবান এক ধারা একাত্তরে এসে যুক্ত হয় বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী প্রবাহের সঙ্গে। শুধু মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যই নয়, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন-সাধনা, জীবন ও কর্ম নিয়েও সমান্তরালভাবে রচিত হতে থাকে নতুন মাত্রার সাহিত্য। কবিতা-ছড়া-গান, গল্প-উপন্যাস-নাটক—কী নেই এ সাহিত্যধারায়! বড়দের সাহিত্য, ছোটদের সাহিত্য, কিশোর সাহিত্য—এ ধারার সব সাহিত্যকর্মের কেন্দ্রে আছেন বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতির অনির্বাণ দীপশিখা। তাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে অনন্য এ সাহিত্যধারা। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেন, প্রাথমিক আবেগ থিতিয়ে এলে এ সাহিত্যধারা ধীরে ধীরে স্রোতহীন নদীর মতো শুকিয়ে যাবে, নীরস-নিষ্প্রাণ হয়ে পড়বে এবং আরও কত মন্তব্য! প্রাথমিক আবেগ কাকে বলে? মুক্তিযুদ্ধের বহু আগে থেকেই শুরু হয়েছে বাঙালির স্বাধীনতাস্পৃহা নিয়ে সাহিত্য রচনা, মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে এ ধারা প্রবল বেগবান হয়ে ওঠে এবং এখন পর্যন্ত এ ধারা যথেষ্ট সচল আছে। মুক্তিযুদ্ধের পর জন্মগ্রহণ করেছেন এমন অনেক সাহিত্যিক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও দিব্যি মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য রচনা করে চলেছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এ ধারায় নতুন নতুন লেখক যুক্ত হচ্ছেন এবং আশা করা যায় আরও অনেকে হবেনও। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বঙ্গবন্ধুকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই কমে আসছে, তবুও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সাহিত্য রচনার ধারা মোটেই ক্ষীণতর হয়নি। সে সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। তারপরও প্রাথমিক আবেগ থিতানোর কথা আসে কোথা থেকে! আসলে এ শ্রেণির সমালোচকরা এ আবেগের উৎস কোথায় সেটাই হয়তো ধরতে পারেননি। মা কিংবা মাতৃভূমি নিয়ে আবেগের শেষ হয়? পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মাতৃভূমির মুক্তি তথা স্বাধীনতা নিয়ে স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের আবেগের বুঝি কোনো সীমা-পরিসীমা হয়! তাহলে স্বাধীনতার স্বপ্নপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে আকাশস্পর্শী আবেগের শেষ হবে কীভাবে! বস্তুতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য, স্বাধীনতা-মহাকাব্যই তার সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা। যতদিন এ জাতির বুকের গভীরে স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধু ধ্রুবতারা হয়ে জেগে থাকবেন, বাঙালি হৃদয়-আকাশে ততদিনই বাঙালির কলমে আবেগমথিত সাহিত্য রচিত হবে সেই ধ্রুবতারাকে ঘিরে।
পরাধীন একটি জাতির মানসজগতে পরিবর্তন এনে কঠোর আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নে উচ্চকিত করে তোলার যে শৈল্পিক নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন, তাই দেখে বিদেশি সাংবাদিক তাকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ বলে অভিহিত করেছেন। হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক উদারনৈতিক বাঙালির কারুময় জীবনাচার থেকে পাঠ নিতে নিতে বেড়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু, ইতিহাস তাকে জয়মাল্য পরিয়ে যেমন অসামান্য উচ্চতায় আসন দিয়েছে, চিরদিনের অবহেলিত নিপীড়িত বঞ্চিত বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার স্বর্ণদুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে তিনিও এ জাতিকে বীরের জাতির মর্যাদায় অভিষিক্ত করে তুলেছেন। বাঙালির জাতিগত পরিচয় আজ আর মোটেই অগৌরবের নয়, বরং স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে হয়ে উঠেছে অহংকারের, গর্বের, মর্যাদা এবং সম্মানের, নিঃসন্দেহে এটা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্ব ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের কল্যাণেই। ‘রাজনীতির কবি’ তিনি, গোটা জীবনের রাজনীতি-সাধনার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা-কাব্যের চেয়েও বড় আর কোনো মহাকাব্য রচনা করবেন! মধুসূদন-রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্তের কাব্য সাধনার চেয়ে কোনো অংশে কম কিছু নয় রাজনীতির কবির এ মহৎ সাধনা। বরং এ কথাই জোর দিয়ে বলা যায়, বাঙালি কবি-সাহিত্যিকরা তাদের অমর কাব্য-সাধনায় বাঙালি জাতির বুকে স্বাধীনতার যে স্বপ্নসাধ বপন করেছেন লিখনীর মাধ্যমে, বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিব তাকেই বাস্তবায়ন করেছেন রাজনীতি-সাধনার মাধ্যমে, স্বাধীনতার ফসল তুলে দিয়েছেন বাঙালির ঘরে ঘরে। কাজেই মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতার পাশাপাশি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও যে বিপুল পরিমাণে সাহিত্য রচিত হবে, এটাই স্বাভাবিক, এটাই প্রত্যাশিত।
পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বাঙালির মাথা উঁচু করা দর্প সত্যিই চূর্ণ হয়েছে। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক এবং তাদের তাঁবেদার বাহিনী যে কাজ করতে পারেনি, বাংলাদেশের ঘৃণ্য এক কুচক্রী মহলের ইন্ধনে কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্য ইতিহাসের সেই কুক্ষণে রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই পৈশাচিক কাণ্ডটি সম্পন্ন করেছে। তাদের এ নারকীয় অপকর্ম বাঙালির বীরত্বপূর্ণ পরিচয়কে করছে কালিমালিপ্ত, সহস্রাব্দের সমূহ অর্জনকে করেছে ধূলি-ধূসরিত, ইতিহাসের গতিমুখ করেছে বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত। বাঙালির এ মহানায়কের জীবনের ট্র্যাজিক পরিণতি গোটা জাতিকে করেছে মর্মাহত, স্তম্ভিত। বিপন্ন বাঙালি তবু আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে সেই মহান নেতার সংগ্রামী জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে তার অচরিতার্থ স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামমুখর জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় নিয়ে বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরেও কত ভাষায় কত যে শিল্প-সাহিত্য রচিত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে, তার বুঝি সীমা-পরিসীমা নেই। বিশেষ করে বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্পৃহাকে শৈল্পিক প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়ে তিনি যে সুবর্ণ অধ্যায় রচনা করেন এবং পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট তাকে বর্বরোচিতভাবে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালির শৌর্যমণ্ডিত ইতিহাসে যে শোকাবহ ও কালিমালিপ্ত অধ্যায় যুক্ত হয়, যুগপৎ এ দুটি ঘটনাই সংবেদনকাতর বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিককে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। তারই অনিবার্য প্রভাব পড়ে বাংলা ভাষায় রচিত অসংখ্য কবিতায়-গানে-গল্পে-নাটকে-উপন্যাসে এবং অন্যান্য সৃজনশীল শিল্পমাধ্যমে। সত্যি এ এক বিস্ময়কর ঘটনাই বটে। কোনো রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে এত বিপুল এবং বৈচিত্র্যময় শিল্প-সাহিত্য রচনার দৃষ্টান্ত বিরল।
যুগপৎ দুটি ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করে—বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের সুযোগ আসে খুব কাছাকাছি সময়ে। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বছরব্যাপী বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের পরিকল্পনা এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ণাঢ্যভাবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু মানবসভ্যতার হুমকি হয়ে সারা বিশ্বের কাঁধে চেপে বসা অচেনা মহামারি করোনার আঘাতে বিপন্ন এ দুঃসময়ে বাঙালি জাতি এ দুটি উৎসব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। তবুও বাঙালি লেখকরা এ উপলক্ষ মাথায় রেখে একদিকে যেমন স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে অসংখ্য সাহিত্য রচনা করেছেন, অন্যদিকে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়েও বিপুল পরিমাণে সাহিত্য রচনা করেছেন। জাতীয় মননের প্রতীক বাংলা একাডেমি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একাধিক বই প্রকাশ করে আসছে। আর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে উদ্যোগ নেয় বঙ্গবন্ধুবিষয়ক একশ বই প্রকাশের। এ এক বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। শুধু বাংলা একাডেমি নয়, এ ধরনের বিশেষ প্রকাশনা-উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, এমনকি বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনও। শিশু-কিশোরদের মানস গঠনের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিশু একাডেমি রঙে রেখায় মনোরম অলংকরণে অত্যন্ত বর্ণাঢ্যভাবে ২৫টিরও বেশি বই প্রকাশ করেছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। সরকারি এসব প্রকাশনার পাশাপাশি এ দেশের বেসরকারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোও এ ক্ষেত্রে মোটেই পিছিয়ে নেই। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বই তারা গত ৫০ বছর ধরেই প্রকাশ করে আসছে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের বিশেষ তাৎপর্যকে বিবেচনায় রেখে আরও অধিক মনোযোগ দিয়েছে এই বিশেষ দিকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটির উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা ও ছড়া নিয়ে উচ্চমানের পৃথক পৃথক সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশে এমন কোনো সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে না যারা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একাধিক বই প্রকাশ করেনি। বই বিপণনের ক্ষেত্রে সরকারি আনুকূল্য লাভের প্রত্যাশা থেকেই যে এই বিপুল বইপত্র প্রকাশের আয়োজন হয়েছে তা ঠিক নয়, এর সঙ্গে প্রকাশকদের দেশপ্রেম এবং বঙ্গবন্ধুপ্রীতিও অনেকাংশে জড়িয়ে আছে, সে কথা মানতেই হয়। বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বইপুস্তকের সহজপ্রাপ্যতার কথা মাথায় রেখে বর্তমানে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিতে বঙ্গবন্ধু কর্নার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সন্দেহ নেই, সব বিবেচনাতেই এটা একটা শুভ উদ্যোগ। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কৌতূহল ও আগ্রহ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকাও পালন করবে এ উদ্যোগ। আগামী দিনে তাদের কৌতূহল মেটানোর প্রয়োজনেও বঙ্গবন্ধুবিষয়ক সাহিত্যচর্চা অব্যাহত থাকবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। ফলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাক বা না থাক, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় বঙ্গবন্ধুবিষয়ক শিল্পসাহিত্য চর্চার ধারা অব্যাহত থাকবে বাঙালির জাতীয় স্বার্থেই।
বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার ভূগোল শুধু বাংলাদেশের মধ্যে সীমিত নয়, এ কথা মানতেই হবে—যতদূর বাঙালির বাস, ততদূর বিস্তৃত বাংলা সাহিত্য। সবার আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কথাই বলতে হয়। বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের কবি সাহিত্যিকের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও এই সত্য উচ্চারণ করতেই হয়—তাদের সাহিত্যে একুশের প্রভাব নেই, মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব নেই, বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গও নেই বললেই চলে। ভাষা-আন্দোলনের সাহিত্যধারা এবং মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যধারা যুক্ত হওয়ার ফলে বাংলা সাহিত্যে যে নতুন মাত্রার সন্নিবেশ ঘটেছে, এখানে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের কোনোই ভূমিকা নেই, নতুন মাত্রার এ সাহিত্যের স্পন্দন খুব সংগতকারণেই তারা যথাযথভাবে উপলব্ধি করতেও পারেন না। তাদের নিজস্ব দীনতা ঢাকতে গিয়ে কেউ কেউ চিরায়ত সাহিত্যের ধুয়া তুলে বাংলাদেশের প্রাণের স্পন্দনযুক্ত এ নতুন মাত্রার সাহিত্যধারাকে সাময়িক উচ্ছ্বাসের কথা বলে তাচ্ছিল্য করতে চান। আমরা শিল্প-সাহিত্য চর্চার নেপথ্যে আবেগের উপস্থিতি সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করে বলতে চাই—বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত সাহিত্যধারা মূলত বাংলা সাহিত্যকেই অধিকতর সমৃদ্ধ করেছে, প্রাণসম্পদে ভরপুর করেছে। বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের পরিপূর্ণ পরিচয় পেতে চাইলে এ নতুন মাত্রার সাহিত্যধারাকে বাদ দিয়ে সেটা কিছুতেই পাওয়া সম্ভব নয়। এটা এতটাই অনিবার্য এবং অপরিত্যাজ্য।
সবশেষে এ ধারার সাহিত্যচর্চার একটি দুর্বল দিকের কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেটা হচ্ছে বিপুল পরিমাণের এ বইপুস্তকের সাহিত্যমানের প্রসঙ্গ। প্রথমত স্বীকার করতেই হয় বঙ্গবন্ধুবিষয়ক অনেক বই লেখা হয়েছে লেখকের কাঁচা আবেগ থেকে, যেগুলো সত্যিকারের বিচারে মানোত্তীর্ণ নাও হতে পারে। দ্বিতীয়ত আমাদের দেশের প্রায় সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান উপযুক্ত সম্পাদনা ছাড়াই বই প্রকাশে অভ্যস্ত হওয়ায় প্রকাশের আগে বইয়ের মান নিশ্চিত করা হয় না। ফলে দুর্বল মানের অনেক বইও রঙিন প্রচ্ছদে মুড়ে বাজারে এসে ভিড় জমায়। তৃতীয়ত প্রকাশনা আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে এবং মুদ্রণশিল্প সহজলভ্য হওয়ার কারণে ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেক মানহীন বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বই এসে বাজারে আবর্জনা সৃষ্টি করে। কিন্তু এতে ভয় পাওয়ারও কিছু নেই, নাক সিটকানোরও বিশেষ প্রয়োজন নেই। জোয়ার নেমে গেলে ভেসে আসা খড়কুটো নদীতীরে পড়ে থাকতেই পারে, তাতে নদীর মূলধারার কী যায় আসে! আবর্জনা যেখানে যাওয়ার ঠিক সেখানেই যাবে, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক মানসম্মত সাহিত্যের ধারা নদীর মতোই বহমান থাকবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক