রীতা ভৌমিক
প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৩, ১০:১৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের পতাকা দেখলেই কান্না আসে বীরপ্রতীক ডা. সিতারা বেগম

বাংলাদেশের পতাকা দেখলেই কান্না আসে বীরপ্রতীক ডা. সিতারা বেগম

চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে দেশে এসেছিলেন বীরপ্রতীক ডা. সিতারা বেগম। শিগগিরই তার লেখা উইপিং হার্ট নামে একটি বই বের হচ্ছে। লিখেছেন—রীতা ভৌমিক

একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ঈদের ছুটিতে বড় ভাই ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার ও ডা. সিতারা বেগম কিশোরগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে আসেন। ছুটি শেষে ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার তাকে আর ক্যান্টনমেন্টে যেতে দেননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পরপরই ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার ভারতে চলে যান। পরবর্তী সময়ে বাবা-মা, ছোট বোন ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম, বোনের মেয়েকেও তিনি ভারতে নিয়ে যান। তাদের সঙ্গে ৩০ থেকে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নৌকায় এসেছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ডা. সিতারা বেগম সেক্টর-২-এর অধীনে মেলাঘরে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন।

বীরপ্রতীক ডা. সিতারা বেগম সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আমরা যখন ভারত সীমান্ত টেকেরঘাট পৌঁছলাম। আমাদের নিতে ভাইয়া এলেন। ওইদিন ওখানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন। আমার সোনার বাংলা গান বাজছিল। আমি একটা ঘরের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল। অনেক কষ্টে সেখান থেকে বালাট পৌঁছাই। এখানে আমাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হলো। এটা বেসামরিক এলাকা। বিরাট এক লরিতে চড়ে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে। লরিতে বড় বড় সিমেন্টের বস্তা। ভাইয়া-আব্বা সামনে বসেন। আমি, আম্মা আর বোনের মেয়ে পেছনে বসি। আমরা যখন গন্তব্যে পৌঁছলাম, তারা বললেন, আপনাকে তো থানায় রিপোর্ট করতে হবে। টিলার ওপর একজন মেজর ছিলেন। রিপোর্ট করার জন্য ভাইয়া টিলা বেয়ে ওপরে উঠে অনুমতি নিয়ে এলেন। আমরা দু-তিন দিন সেখানে একজন বাঙালি ভদ্রলোকের বাড়ির একটা ঘরে আটজন মানুষ থাকি। তিনি বাংলাদেশের লোক। আমাদের খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ালেন। মেজর ভাইয়াকে বলে দিয়েছিলেন, আমাদের একসঙ্গে না বেরোনোর জন্য। একজন একজন করে গাড়িতে উঠলাম।

ওখান থেকে আমরা শিলং এলাম। শিলংয়ে আব্বা আর ভাইয়া অফিসার মেসে উঠলেন। আম্মা, আমি আর বোনের মেয়ে নীলা টি বাগানের ম্যানেজারের বাসায়। উনার বাড়িতে তিন-চার দিন থাকলাম। ভাইয়া অস্থির কীভাবে এখান থেকে বের হবেন। কারণ তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। সেখান থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে আমরা এলাম গৌহাটি। এখানে পৌঁছানোর আগেই প্লেন ছেড়ে চলে যায়। আগরতলা যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। মেজর আমাদের বললেন, আজকেই একটা অতিথিশালা খোলা হয়েছে, আপনারা এর অতিথি হন। ভাগ্য ভালো, ওখানে দুদিন থেকে প্লেনে আগরতলা এলাম। কিন্তু সমস্যা হলো আমার কাছে একটা পিস্তল ছিল। ভাইয়া পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি কখনো কোনো বিপদে পড়ো নিজেকে রক্ষার জন্য গুলি করবে।’ আর একটা গ্রেনেড দিয়েছিলেন। সেটা আমার শাড়ির আঁচলে বাঁধা থাকত। এভাবেই চলেছি। আগরতলায় পৌঁছে দেখি মেজর খালেদ মোশাররফ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। ভাইয়ার জন্য জিপ এসেছে। জিপে মেলাঘরে এলাম। মেলাঘরে আমাদের থাকার জায়গা নেই। মেজর খালেদ মোশাররফ ভাই বললেন, ‘হায়দার তোমার-আব্বা-আম্মাকে আমার রুমে থাকতে দাও।’ আমরা উনার রুমে থাকলাম। উনি থাকলেন তাঁবুতে। আব্বা বললেন, ‘এটা হয় না। আমরা উনার রুমে থাকব আর উনি তাঁবুতে থাকবেন।’ একটা মাটির ঘরে উঠলাম আমরা। এমিনেশন বক্স দিয়ে খাট আর বসার জন্য দুটি জলচৌকি তৈরি করা হয়েছে। আমি ভাইয়াকে বললাম, আমি হাসপাতালে যাব। আমি বাংলাদেশ হাসপাতালে এলাম। মুক্তিযুদ্ধে গুলিতে আহত যোদ্ধাদের পাশাপাশি ভারতীয় জনগণকেও সেবা দিয়েছি। একজন মুক্তিযোদ্ধার টিটেনাস হয়েছে। আমাদের চিকিৎসা দেওয়ার সরঞ্জাম নেই। আমাদের রেডক্রসের অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে চিকিৎসার জন্য আগরতলা পাঠিয়ে দিলাম। পাঁচ বা ছয় দিন পর ওখানকার ডাক্তার ব্যানার্জি কয়েকজন ডাক্তার নিয়ে এলেন। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা আহত ওই মুক্তিযোদ্ধার কোনো খবর আছে। তিনি কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। এরপর বললেন, ‘ক্যাপ্টেন সিতারা আমরা ওকে বাঁচাতে পারিনি।’ মুক্তিযোদ্ধার নাম আসানউল্লাহ, বাড়ি ছিল নরসিংদী। বিএ পাস। ওর মৃত্যু খবর মায়ের কাছে পৌঁছাব সেটাও সম্ভব ছিল না।

তিনি আরও বলেন, আমার ভাইয়া পরবর্তী সময়ে মেজর এ টি এম হায়দার বাংলাদেশের স্বাধীনতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল লেফটেন্যান্ট জগজিৎ সিং অরোরার পাশে আমার ভাইয়ার ছবিটি বড় করে বাঁধিয়ে রেখেছি। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন আপনি ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম। আপনাকে তো চিনলাম। কর্নেল হায়দার কে? তাদের মধ্যে আর্মি অফিসাররাও আছেন। তাদের তো আরও ভালো করে জানা উচিত ছিল। আমি তাদের প্রশ্নের উত্তরে বললাম, কর্নেল হায়দার কে জানেন না! তিনি বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ভাইয়ার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। তাকে হত্যা করা হয়েছিল। সে সময়ে আমি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে স্বামীর সঙ্গে ছিলাম। দুই সপ্তাহ পর সংবাদ পেলাম, ভাইয়াকে মেরে ফেলা হয়েছে। ফোনের কোনো সুবিধা ছিল না। ফোন করলে বলতেন ম্যাডাম ঢাকার লাইন পেলাম, কিশোরগঞ্জের লাইন পাচ্ছি না। প্রায় দেড় মাস পর আব্বার সঙ্গে একটুখানি কথা বলতে পারি। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারিনি। ভাইয়া নেই, কান্না করছিলাম। ভাইয়াকে হারিয়েছি স্বাধীন দেশে, যে দেশের স্বাধীনতায় ভাইয়া প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এ দুঃখে আমি বাংলাদেশে আসতে চাইনি। বাংলাদেশের পতাকা দেখলেই আমার কান্না আসে।

এ জন্য দেশে আসার আগে, আমার স্বামী একাত্তরের রণাঙ্গনের আরেক মুক্তিযোদ্ধা বিশিষ্ট ভাসকুলার সার্জন ও সেনা কর্মকর্তা ডা. আবিদুর রহমানকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছি, তুমি কাউকে বলবে না ডা. সিতারা দেশে এসেছে। ডাক্তারদের কাছে আমার পরিচয় দেবে না। ডা. জাফরুল্লাহর ২৫তম বিবাহবার্ষিকীতে আসতে পারব না বললেও উনি শুনলেন না। আমার বাচ্চাদের স্কুল খোলা ছিল। আমার স্বামীও শিডিউল পরিবর্তন করতে পারবেন না। এটা শুনে জাফর ভাই বললেন, ‘আপনাকে আসতে হবে। ইভ ইউ ডোন্ট কাম, ডেডবডি হ্যাভ টু কাম।’ আসতেই হলো তার অনুরোধে। আমার একটি নতুন বই আসছে উইপিং হার্ট নামে। আমি বইটির নাম রাখতে চেয়েছিলাম শরাহত পাখি। পরে উইপিং হার্ট রাখা হয়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে কুমিল্লায় গাছ লাগাচ্ছে ছাত্রলীগ

ফরিদপুরের ঘটনা আদিম যুগের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে : আব্দুর রহমান

২৪ ঘণ্টায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ২ কর্মী খুন

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে বিপদে জর্ডান

‘হারল্যান স্টোর’ মিরপুর-১০ শাখার উদ্বোধন করলেন নুসরাত ফারিয়া

ভোলায় হিটস্ট্রোকে যুবকের মৃত্যু

ফিতরা জাকাতের টাকা চেয়ে খুদে বার্তায় প্রতারণার ফাঁদ

এক সপ্তাহের মধ্যেই পরমানু বোমার ইউরেনিয়াম পাবে ইরান!

ননদের বিয়েতে টিভি উপহার দিতে চাওয়ায় স্বামীকে হত্যা

মেঘনা নদীতে ভেসে এলো খণ্ডিত পা

১০

ঈশ্বরদীতে হিটস্ট্রোকে স্বর্ণকারের মৃত্যু

১১

সুচিত্রা সেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘মাইক’ পুরস্কৃত

১২

নারী চিকিৎসকের সেবা নেওয়া রোগীদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি : গবেষণা

১৩

সরকারকে পরাজয় বরণ করতেই হবে : মির্জা ফখরুল

১৪

দেশে ফিরে কারাগারের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন তারা

১৫

হরমোনজনিত সমস্যায় দেশের ৫০ শতাংশ মানুষ, জানেন না ৯০ শতাংশই

১৬

আনু মুহাম্মদের পায়ে আবারও অস্ত্রোপচার করা হবে

১৭

বুয়েটে হিযবুত ও শিবিরের কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশই শুধু সমস্যা!

১৮

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে সংবর্ধনা দিল বিমান 

১৯

আরও ৩ দিন হিট অ্যালার্ট জারি

২০
*/ ?>
X