বিশ্বব্যাংকের দিকে তাকিয়ে দুর্ঘটনা রোধের উদ্যোগ

বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংক।ছবি : সংগৃহীত

ঋণনির্ভর দেশের সড়ক নিরাপত্তা কার্যক্রম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, গত এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান আরও চারধাপ নিচে নেমেছে। বেসরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যানেও সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ২৯ ভাগ। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যাও।

এ পরিস্থিতিতেও দুর্ঘটনারোধে লিফলেট বিতরণ ও বিআরটিএ সদর দপ্তরের জনসচেতনতায় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো প্রকল্প সরকারের হাতে নেই। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণের অর্থছাড় করার পরই বৃহৎ পরিসরে সড়ক দুর্ঘটনারোধে কাজ শুরু হবে। ওই ঋণের দিকেই তাকিয়ে দুর্ঘটনারোধের নানা উদ্যোগ।

সড়ক নিরাপত্তায় ঋণ দিতে বিশ্বব্যাংকে প্রস্তাব দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। পরে গত বছরের ২৮ মার্চ ৩ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিয়েছে অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী এ প্রতিষ্ঠান। ‘নিরাপদ সড়ক প্রকল্প’ আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে এই অনুমোদন দেওয়া হয়।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্প করে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এনালগ সড়কে প্রকল্পের মধ্য দিয়ে ডিজিটাল কার্যক্রম শুরু করলে তা দ্রুতই মুখ থুবড়ে পড়বে। এ জন্য সড়ক নিরাপত্তার জন্য ধাপে ধাপে পরিকল্পনা ও ধারাবাহিক মনিটরিং জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

প্রকল্প নিয়ে কতটুকু সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক কালবেলাকে বলেন, প্রকল্প নিয়ে কাজ করা এখন সব বিভাগের একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। প্রকল্পের কারণে উন্নয়নের জন্য এনফোর্সমেন্ট ও পর্যবেক্ষণের আগ্রহ হারাচ্ছেন দায়িত্বশীলরা।

প্রকল্প করে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে ড. এম শামসুল হক বলেন, বিজ্ঞান বলে শৃঙ্খলা ধরে রাখাই উন্নয়নের বড় শর্ত। তাই সড়ক নিরাপত্তা ইস্যুতে পরিকল্পিতভাবে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বিলাসী প্রকল্পে কাজ হবে না।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত চারটি ভাগে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এর একটি অংশে রয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ), পুলিশ ও স্বাস্থ্য বিভাগ।

প্রকল্পটির মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা পরিমাপ, উন্নত নকশা, প্রকৌশল সুবিধা, গতি প্রয়োগ, জরুরি সেবাসহ সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় যানজটের হৃৎপিণ্ড হিসেবে পরিচিত জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার ও নাটোর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার সড়কে প্রাথমিকভাবে বসানো হবে নম্বর প্লেট শনাক্তকরণ ডিভাইস। ফলে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে কোনো চালক পার পাবে না। পদক্ষেপটির মাধ্যমে দুই মহাসড়কে ৩০ শতাংশের বেশি সড়ক দুর্ঘটনা কমতে পারে।

প্রকল্পের আওতায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সড়ক নিরাপত্তা উন্নয়নে পাঁচ হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক নিরাপদ করা হবে। অগ্রাধিকার বিবেচনায় বিভিন্ন ইন্টার সেকশনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মাত্রার পূর্ত কাজের মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা বাড়ানো হবে বলেও জানা গেছে।

ট্রাফিক পুলিশসহ অন্য সংস্থার ব্যবহারের জন্য স্থাপন করা হবে জাতীয় ডাটা সিস্টেম। জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা এবং নাটোর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত ১৪০ কিলোমিটার মহাসড়কে বসানো হবে সিসিটিভি। স্থাপন করা হবে ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনসিডেন্ট ডিটেকশন সিস্টেম। কেউ যদি বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায় ও কোনো দুর্ঘটনা ঘটায় তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটি ধরা পড়বে। দেশে মোট সড়ক রয়েছে ২১ হাজার ৫৯৫ দশমিক ৪৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৭২ কিলোমিটার সড়ক ‘মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এসব সড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বসানো হবে প্রযুক্তি। এতে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ থাকবে না চালকদের।

বিশ্বব্যাংকের ঋণে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে করা প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন। জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, প্রকল্পটি একনেকে পাস করতে দুই সপ্তাহ আগে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। পাশ না হওয়া পর্যন্ত কবে থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু সম্ভব হবে, তা বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য, বিআরটিএ, সড়ক ও জনপথসহ পুলিশ বিভাগ মিলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। আমাদের প্রত্যাশা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক উন্নত হবে।

প্রকল্পের বিআরটিএ অংশের দেখভাল করবেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (প্রকৌশল) সীতাংশু শেখর বিশ্বাস। জানতে চাইলে তিনি বলেন, সড়ক নিরাপত্তায় বিশ্বব্যংকের ঋণ দেওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের বোর্ড সভায় গত বছর পাস হলেও এখন পর্যন্ত অর্থ ছাড় হয়নি।

ঋণ দেওয়ার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মহাসড়ক ও জেলা সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও আহতদের সংখ্যা কমাতে এই ঋণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ‘নিরাপদ সড়ক প্রকল্প’ নামের প্রকল্পে এই ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক। এই প্রকল্প বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করবে।

চুক্তির পর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের প্রধান মার্সি টেম্বন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ার প্রধান কারণ এবং শিশু মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ। সড়ক দুর্ঘটনা অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে দরিদ্র পরিবারগুলোকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে সড়কের নিরাপত্তা উন্নত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক এবং উন্নয়ন অগ্রাধিকার।

এদিকে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সারা দেশে দুর্ঘটনার হার ২৯ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)। সংগঠনটি তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে সড়ক, নৌ ও রেলপথে মোট ৭০২৪টি দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ১০৪ জন নিহত ও ৯ হাজার ৭৮৩ জন আহত হয়েছেন।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com