আসিফ
প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৪:০৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবীর কেন্দ্র এখনো একই দিকে ঘুরে চলছে

পৃথিবীর কেন্দ্র এখনো একই দিকে ঘুরে চলছে

পৃথিবী তার অক্ষকে কেন্দ্র করে যে অভিমুখে ঘুরছে, তার অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রটি ঘুরছে ঠিক তার বিপরীত অভিমুখে: সম্প্রতি নেচার জিয়োসায়েন্সের একটি গবেষণায় বিষয়টিকে এভাবে তুলে ধরা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কিছুদিন আগে পৃথিবীর কেন্দ্র ঘোরা থামিয়ে দিয়েছিল। তার পর থেকেই এটি উল্টোমুখে ঘোরা শুরু করেছে। অনেক গণমাধ্যম সংবাদটি এমনভাবে পরিবেশন করেছে, যাতে মনে হয় পৃথিবীর মহাপ্রলয়ের বেড়াজালে ঢুকে পড়েছে।

শিরোনামগুলো লক্ষ্য করি, ‘হঠাৎ ঘোরা থামাল পৃথিবীর কেন্দ্র, এবার ঘুরছে উলটো দিকে! কতটা সংকটে জীবজগৎ’; ‘থেমে গেল পৃথিবীর কেন্দ্রের ঘূর্ণন! উল্টো দিকে ঘুরছে গ্রহের কেন্দ্র’; ‘হঠাৎ থেমে গিয়ে পৃথিবীর কেন্দ্র এবার ঘুরছে উল্টো দিকে!’; ‘উল্টো দিকেও ঘুরতে পারে পৃথিবীর কেন্দ্র’ ইত্যাদি। মজার ব্যাপার, এতে তো পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রেরও পরিবর্তন ঘটবে, উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুও পাল্টাপাল্টি হয়ে যাবে।

বাস্তব কথাটা হচ্ছে, পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ঘূর্ণন আগের মতোই একই দিকে রয়েছে; সূর্যের

চারদিকে এই সজীব গ্রহটি যতদিন আবর্তন করতে থাকবে, ততদিনই তা থাকবে। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক ভূপদার্থবিদ বলেছেন, ‘পুরোপুরি থেমে যায়নি, আগের তুলনায় গতি কমেছে পৃথিবীর কেন্দ্রের।’ তার মতে, এক দশক আগে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রে যে গতি ছিল, তা পৃথিবীর অক্ষ ঘূর্ণনের সঙ্গে নয়, অন্য স্তরের তুলনায় তার গতি বেশি ছিল। বর্তমানে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায়, গতি থেমেছে বলে মনে হচ্ছে। এ কারণে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছে এই পরিবর্তন জীবকুলের ওপর কোনো খারাপ প্রভাব পড়ার কারণ নেই।

পৃথিবী সলিড কোনো বল নয়। অনেকগুলো স্তরের সমষ্টি, এক স্তর থেকে আরেক স্তরে গতির ভিন্নতা রয়েছে। পৃথিবীর স্তরগুলো হচ্ছে ক্রাস্ট বা ত্বক, ম্যান্টল বা লাভা এবং কোর বা কেন্দ্র। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট তরঙ্গের গতি-প্রকৃতি পরীক্ষা করতে গিয়ে ১৯৩৬ সালে প্রথম বিষয়টির আভাস পান বিজ্ঞানীরা। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত হওয়া সমস্ত ভূমিকম্পের তরঙ্গ গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে পিকিং ইউনিভার্সিটির গবেষকরা জানিয়েছেন, ঘূর্ণনের এই পরিবর্তন সম্ভবত দিনের দৈর্ঘ্যের পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত। এটি অক্ষের ওপর পৃথিবীর ঘূর্ণনে ছোট পরিবর্তন আনতে পারে। দিনের দৈর্ঘ্যর পরিবর্তনে পৃথিবীর জীবজগতের ওপর কতটুকু প্রভাব পড়তে পারে, তা বলা মুশকিল। তবে সেটা অবশ্যই তাৎক্ষণিক নয়, দীর্ঘমেয়াদি।

এই কোর বা কেন্দ্র দুভাগে বিভক্ত: একটি হলো আমাদের গ্রহের অভ্যন্তরীণ কেন্দ্র নিকেল ও লোহার একটি কঠিন ভর রয়েছে, যা প্রায় ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার চওড়া ব্যাসার্ধের একটি গোলকে মহাকর্ষের বাঁধনে প্রবলভাবে আটকে রয়েছে। এই কঠিন কেন্দ্রটি আবার লোহা ও নিকেলের তরল প্রলেপ দিয়ে ঘেরা তরল বহি কেন্দ্র। এই কেন্দ্রটির ঘূর্ণনই পৃথিবীর প্রতিরক্ষামূলক ভূ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে, যা মহাজাগতিক রশ্মি থেকে পৃথিবীর জীবজগৎকে বাঁচায়। এ ছাড়া লোহা নিকেলের বাইরে ম্যান্টলের স্তর বা লাভা এবং অবশেষে ভূত্বক রয়েছে। ভূত্বকটি, যেখানে আমরা বসবাস করি তার ২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার নিচে হলো কেন্দ্রটি।

পৃথিবীর অভ্যন্তরের অলিগলি দিয়ে প্রবাহিত হওয়া ভূমিকম্প-তরঙ্গগুলোর মাধ্যমে আমরা জানতে পারছি অনেক তথ্য। গ্রহের অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রটি গত এক দশক ধরে ত্বক বা পৃষ্ঠ অপেক্ষা যে বেশি ঘুরত, সেটি কমে গেছে। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি পৃথিবীর পৃষ্ঠ সাপেক্ষে তার কোনো ঘূর্ণন নেই। এখন ঘূর্ণনহার আরও কমে যাওয়ায় পৃষ্ঠ সাপেক্ষে দেখতে পাচ্ছি, অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রটি বিপরীতভাবে ঘূর্ণনের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কয়েক দশকের গবেষণায়, ভূমিকম্প জেগে ওঠার সাপেক্ষে গ্রহ অভ্যন্তরে চলাচলকারী ভূমিকম্প তরঙ্গগুলোর আচরণ থেকে কেন্দ্রটির আচরণ অনেকটাই বোঝা সম্ভব হয়েছে।

ভূমিকম্প তরঙ্গসমূহ বিবেচনায় নিয়ে বিজ্ঞানীরা অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য-সংক্রান্ত গবেষণা করেছেন। এটি করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, ভূমিকম্পের তরঙ্গগুলো একই অবস্থান থেকে উদ্ভূত হলে তাদের ঠিক একই পথে ভ্রমণ করা উচিত। এভাবে সিসমোগ্রাফের রেকর্ডে একই ধরন থাকতে হবে। যদি কোনো পার্থক্য থাকে, তবে বুঝতে হবে পৃথিবীর অভ্যন্তরে কিছু বদলেছে। বারবার ঘটা শক্তিশালী ভূমিকম্প থেকে পাওয়া ভূমিকম্প তরঙ্গ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে।

ফলে এর সর্বোত্তম ব্যাখ্যাটি হচ্ছে—অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রটির ঘূর্ণন বাইরের স্তরের তুলনায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে। এর মানে হচ্ছে, কেন্দ্রটি আসলে সর্বদা একই দিকে ঘোরে যেদিকে পুরো গ্রহটি ঘোরে (পূর্ব দিকে), তবে কখনো কখনো এটি বাইরের স্তরগুলোর চেয়ে অনেক দ্রুত ঘোরে, কখনো এটি ধীর হয়ে যায়। এমন সময় আসে যখন বাইরের স্তরের ঘূর্ণনের সঙ্গে মিলে যায়। তাই পৃথিবীর পৃষ্ঠের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কারও কাছে এই তিনটি দশা পর্যায়ক্রমে উপস্থিত হতে পারে, যেন কেন্দ্র সামনের দিকে ঘুরছে, পেছনের দিকে ঘুরছে অথবা ঘূর্ণনটি বন্ধ হয়ে গেছে।

১৯৬৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চিনের বেইজিং পিকিং ইউনিভার্সিটিতে সিনোপ্রোব ল্যাব থেকে গবেষক ইয়া ইয়াং এবং জিয়াওডং সং অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রের ঘূর্ণনের বিন্যাস সম্পর্কে জানতে গিয়ে এগুলো উন্মোচন করেন। পুনরাবৃত্তি ঘটা ভূমিকম্প তরঙ্গ উৎসের সন্ধান দিতে গিয়েই এ রহস্যের উন্মোচন ঘটে। ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের ফলাফলগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রটি বাইরের স্তরের সাপেক্ষে ঘূর্ণন বন্ধ করে দিয়েছে। ২০২০ সালের পর এটি পেছন দিকে ঘুরছে বলে মনে হচ্ছে। কেন্দ্র ঘূর্ণনের অনুরূপ ধরন ১৯৬০-এর দশকে শেষের দিকে এবং ১৯৭০-এর দশকের গোড়ায় পাওয়া গিয়েছিল। এও জানা গেছে, প্রতি ৩৫ বছর ৭০ বছরের পর্যায়কালে পরিবর্তনের এই পুনরাবৃত্তি ঘটে।

অতএব, পেছনের বা উল্টোদিকে ঘোরার মূল কথাটি হচ্ছে তখনই, যখন আমরা গ্রহ পৃষ্ঠের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার সাপেক্ষে ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করি। এ ধরনের পরিবর্তনে প্রাণীকূলের অস্তিত্ব বিপণ্ন হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। পৃথিবীর উপরিতলে এই ঘূর্ণনের প্রভাব টেরও পাওয়া যাবে না। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর শিরোনাম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিজ্ঞানঘনিষ্ট হওয়ার আহ্বান জানাই।

লেখক: বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

খালেদা জিয়ার অবস্থা গুরুতর : মির্জা ফখরুল

জামালপুরে অবরুদ্ধ সাব-রেজিস্ট্রার, দলিল লেখকদের বিক্ষোভ

কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার: এবার দিল্লিকে নতুন বার্তা ওয়াশিংটনের

সন্ধ্যার মধ্যে ঝড় হতে পারে যেসব অঞ্চলে

ঢাবিতে ‘জোরে হাসা’ নিয়ে মারামারি, দুই শিক্ষার্থীর পাল্টা অভিযোগ 

ফেরদৌস ওয়াহিদের জীবন গল্পে সুর দিলেন পিজিত

ঈদে আসছে নাটক ‘দুনিয়ার খেলা’

বাংলা কলেজের ছাত্রই নন, তবুও ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি

ব্যক্তিগত অর্জন নয়, দেশের জন্য খেলি: সাকিব

বাগেরহাটে নারীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

১০

ফেনীতে এলজিইডির প্রকৌশলী ও কর্মচারীদের মারধর

১১

ধর্ম অবমাননার অভিযোগ : কলেজে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

১২

অবসর গুঞ্জনে যা বললেন মেসি

১৩

নাঙ্গলকোটে সাংবাদিক ইউনিয়নের কমিটি গঠন

১৪

হোয়াইটওয়াশ এড়ানো মিশনে নেই হাথুরুসিংহে

১৫

গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্সের কর্ণধার গ্রেপ্তার

১৬

পিতৃত্ব অস্বীকার করায় যুবদল নেতা কারাগারে

১৭

যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত

১৮

টেকনাফে ফের ৮ জনকে অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি

১৯

রূপায়ণ সিটি উত্তরাতে ক্রিমসন কাপের উদ্বোধন

২০
*/ ?>
X