
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ৩১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে। গত মঙ্গলবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১০৫ কোটি ডলার দায় পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে হয় ৩১ দশমিক ১৪ কোটি ডলার। গত সোমবার রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ২২ কোটি ডলার।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সে হিসাবে ৬ বছর পর আবার আগের জায়গায় নেমে গেছে। আর এক বছর আগে রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ইতিহাসে রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে ২০২১ সালের আগস্টে। তবে করোনা-পরবর্তী সময়ে অস্বাভাবিক হারে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ডলারের সংকট শুরু হয়েছে। একই সময়ে প্রয়োজনের তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রাও অনেক কম আসছে। অর্থাৎ দেশে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, খরচ হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। বাড়তি চাহিদা মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ধারাবাহিকভাবে কমছে রিজার্ভ।
এদিকে ২০২২ সালে রিজার্ভ থেকে ১২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এভাবে ডলার বিক্রির ফলে একদিকে কমছে রিজার্ভ, অন্যদিকে বাজার থেকে টাকা উঠে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এতে রিজার্ভ কমার পাশাপাশি টাকা তারল্যেও চাপ তৈরি হয়েছে। এদিকে ডলারের দামও বেড়ে ৮৫ থেকে ১০৮ টাকায় উঠেছে। অবশ্য আমদানিতে প্রতি ডলারের জন্য দিতে হচ্ছে গড়ে ১০৫ টাকা।
এ অবস্থার উন্নয়নে আমদানি দায় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলারের ওপর চাপ কমাতে ঋণপত্র খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শতাধিক পণ্যে বাড়তি শুল্ক বসিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণের প্রথম কিস্তিও গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী উদ্যোগের ফলে আমদানি কিছুটা কমেছে। এতে গত জানুয়ারি পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের সাত মাসে বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার কমে ১৩ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। চলতি হিসাবের ঘাটতি নেমেছে ৫ বিলিয়নে। তবে আর্থিক হিসাবে বড় অঙ্কের ঘাটতির কারণে সামগ্রিক ঘাটতি সাড়ে তিন গুণ বেড়ে ৭ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে।
বর্তমান রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার হলেও প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ২৩ বিলিয়ন। কারণ, রিজার্ভ থেকে আট বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভের অর্থে দেশে তহবিল গঠন করা হয়েছে। রিজার্ভ থেকে ৭০০ কোটি ডলার (৭ বিলিয়ন) দিয়ে গঠন করা হয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল। আবার রিজার্ভের অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছে লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ), গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)। বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতে ও সোনালী ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হয়েছে। আবার পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতেও রিজার্ভ থেকে অর্থ দেওয়া হয়েছে। এসব মিলিয়ে ব্যবহার হয়েছে আট বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া হয়েছে ২০ কোটি ডলার, যার বিপরীতে সমপরিমাণ শ্রীলঙ্কান রুপি জমা আছে।
প্রসঙ্গত, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে আন্ত-আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে এশিয়ার নয়টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, তা দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়। সর্বশেষ, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসের দায় হিসাবে ১০৫ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। আর অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হয়। আকুর সদস্যদেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। তবে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় শ্রীলঙ্কা এ তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।