
একটি সেসনা এয়ারক্রাফটে যাত্রী হিসেবে চড়ে বসেছে তিন দেশের তিনজন। পাইলট বললেন, বিপৎসংকেত দিচ্ছে, ওজন কমাতে হবে। আমেরিকান লোকটা ককপিট থেকে পাইলটকে তুলে ফেলে দিল। হেসে বলল, আমাদের দেশে পাইলটের অভাব নেই। আমেরিকার কৃষকরাও এ ধরনের সেসনা বিমান চালাতে পারে। রুশ লোকটা উড়োজাহাজের সব জ্বালানি ফেলে দিয়ে বলল, আমরা তো তেল-গ্যাসের ওপর ভাসছি। এটুকু ফেলে দেওয়াই যায়। বাকি রইল এক চীনা। সে উঠে দাঁড়িয়ে নিচে লাফ দেওয়ার আগে বলল, আমাদের দেশে মানুষের অভাব নেই। আমি চললুম।
চীনাদের জনসংখ্যা নিয়ে এমন কৌতুকের দিন কিন্তু শেষ। গত ৬০ বছরে এবারই প্রথম দেশটির জনসংখ্যা দেখা গেল পড়তির দিকে। আর এ নিয়ে দেশটির সরকার আছে দুশ্চিন্তায়।
টেনশনে আছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও। জনসংখ্যা বাড়াতে কোমর বেঁধে নেমেছে তারা। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া তাদের কটিবন্ধ কতটা কষে বেঁধেছে, সেটার প্রমাণ মিলবে গত ১৬ বছরের বাজেটে তাকালে। শুধু জনসংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করার পেছনে এই দেড় যুগে দেশটি ব্যয় করেছে ২০ হাজার কোটি ডলার!
অন্যদিকে, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা গত জানুয়ারিতে বলেছিলেন, হয় এবার হবে, না হয় আর হবেই না। এই হওয়া না হওয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মরিয়া আচরণের পেছনে আছে পরিসংখ্যানের অশনি-চিত্র। ১৯৭০ সালে বছরে দেশটিতে গড়ে ২০ লাখ শিশুর জন্ম হতো। সেখানে গতবছর জন্মেছে ৮ লাখ। সামনের বছরগুলোতে যা আরও কমতে পারে। কিশিদা ঘোষণা দিয়েছেন, শিশুর জন্মহার বাড়ানো সংক্রান্ত নীতিমালার পেছনে দেশটি এবার প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি ডলার বাজেট রাখবে, যা কি না দেশটির জিডিপির ২ শতাংশেরও বেশি।
বিবিসির বরাতে চীনের এক জরিপে দেখা গেছে, সেখানকার ৪০ ভাগ নারীরই বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। বিয়ে করলেও সন্তান নেওয়ার ইচ্ছে নেই আরও বেশি সংখ্যক নারীর। এখনই দেশটির জনসংখ্যার গড় বয়স দাঁড়িয়েছে ৩৮-এ। দেশটিতে বয়স্কদের সংখ্যা বাড়লে এ গড় বয়সও বাড়বে জ্যামিতিক হারে এবং দ্রুতই দেশটিতে বুড়োদের দেখভাল করা কিংবা সংসারের হাল ধরার মতো লোক নিয়ে আসতে হবে ভাড়া করে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির জন্য যা অতিশয় খারাপ খবর বটে।
কেন বাড়াতেই হবে?
আমরা যেখানে প্রায়ই যাবতীয় সমস্যার মূলে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে দোষ দিয়ে পার পাচ্ছি, সেখানে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের একটাই টেনশন, এভাবে মানুষ কমতে থাকলে সামনে কাজ করবে কারা? মানুষ কমে গেলে তো ট্যাক্সও কমে যাবে। সরকার চলবে কী দিয়ে! ক্ষেত-খামারই বা করবে কারা।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, ৬৫ বছরের বেশি মানুষ সবচেয়ে বেশি আছে এমন দেশের তালিকায় জাপান এখন দ্বিতীয় (প্রথমে মোনাকো)। দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ ভাগের বয়সই ৬৫ বছরের বেশি। জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সমাজ হিসেবে আমরা ঠিকঠাক চলতে পারব কি না সে প্রশ্নের একেবারে কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে জাপান।’
দক্ষিণ কোরিয়াও গতবছর নিজের রেকর্ড নিজে ভেঙেছে। সেখানে প্রতি হাজার নারীর বিপরীতে শিশুর জন্ম হচ্ছে ৭৭৮টি। নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েও জনসংখ্যার হালে পানি আনতে পারেনি সিঙ্গাপুর।
জাতিসংঘের পপুলেশন ফান্ডের কর্মকর্তা আলানা আর্মিটেজ বিবিসিকে বলেছেন, জাপান, কোরিয়ার মতো এমন ‘ইনসেনটিভ’ দিয়ে জনসংখ্যা বাড়ানোর কৌশল আদতে কাজে আসে না। তার মতে, জনসংখ্যার এ উল্টোরথের নেপথ্যে নারীর কর্মজীবন ও সামাজিক জীবনের ভারসাম্যহীনতা ও কিছুক্ষেত্রে গর্ভধারণ ক্ষমতা কমে আসার প্রসঙ্গই উঠে আসছে নানা গবেষণায়, তাই নজরটা সেদিকেই দেওয়া উচিত।
শুয়ে থাকলে হবে?
এই সমস্যার ওপর একটা বিষফোঁড়াও আছে। সেটার নাম ‘লাই ফ্ল্যাট’ তথা ‘সোজা শুয়ে থাকো’। বিশেষ করে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোর তরুণ সমাজে এ প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। সেখানকার কর্মক্ষম অনেক তরুণ ঝাঁ চকচকে ক্যারিয়ারের পেছনে দৌড়ে ‘জীবন বরবাদ’ করতে নারাজ। সারাদিন কাজ আর কাজ; এমন চক্রে তারা কিছুতেই পড়তে চায় না। কোনোরকম খেয়ে পরে জীবন চললেই খুশি। যে কারণে এসব দেশে বাড়ছে কর্মক্ষম বেকার ও অনভিজ্ঞ কর্মীর সংখ্যা।
তাই সরকার যতই নীতির পরিবর্তন করুক বা প্রণোদনা প্যাকেজ আনুক, তাতে জনগণ কতটা কান দেবে—সেই প্রশ্নও থেকে যায়।
এই ফাঁকে আমাদের মতো একটু বেশি জনসংখ্যার দেশগুলোর জন্য আশা জাগানিয়া খবর হলো, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার অভিবাসন সম্পর্কিত কর্তারা নাকি ইতিমধ্যে তাদের ইমিগ্রেশনের নিয়ম-কানুন শিথিল করা নিয়ে আলাপ শুরু করেছেন। ভাবছেন, ওই দেশগুলোর বয়স্ক জনগোষ্ঠীর দেখভাল ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য অন্য দেশের তরুণ কর্মীদের ডেকে এনে আপাতত কাজ চালানো যায় কি না।