শীতলপাটি, নকশিকাঁথা কিংবা তালপাতার পাখার মতোই গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হাওয়াই মিঠাই। একটা সময় ছিল, যখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করত ফেরিওয়ালারা। অলস দুপুরে দূর থেকে কানে আসত, হাওয়াই মিঠাই বিক্রেতার হাতের ছোট্ট ঘণ্টার আওয়াজ। তা শুনেই চঞ্চলতা বেড়ে যেত বাড়ির শিশুদের। এক দৌড়ে দল বেঁধে চলে যেত বিক্রেতার কাছে। তিনদিকে কাঁচ লাগানো টিনের বাক্সে থাকত রং-বেরঙের হাওয়াই মিঠাই। কখনো অল্প কিছু পয়সার বিনিময়ে আবার কখনো বাড়ির অব্যবহৃত জিনিসের বিনিময়ে মিলত এ মিঠাই।
সময়ের বিবর্তনে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে এই হাওয়াই মিঠাই। আগে ফেরি করে বিক্রি করা হলেও এখন এর দেখা মেলে বিভিন্ন বিশেষ দিন কিংবা গ্রামীণ মেলায়। তবে শিশু-কিশোরদের কাছে এ মিঠাইয়ের কদর এখনো কমেনি।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি জয়পুরহাট শহরের শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দানের বাইরে দেখা মিলল বৃদ্ধ আবুল কাশেমের। প্রধান সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করছিলেন। কথা বলে জানা গেল, এ ব্যবসার সঙ্গে এক সময় জড়িত ছিল তার মতো অনেকেই। এখন বেশি লাভের আশায় অন্য ব্যবসায় জড়িয়েছেন তারা। তবে দীর্ঘদিনের এ ব্যবসা আঁকড়ে ধরে আছেন আবুল কাশেম।
ছোট বয়স থেকেই হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করেন আবুল কাশেম। বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে। থাকেন পার্বতীপুরে। দুই ছেলের মধ্যে একজন তার মতো হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করেন। আরেকজন ঢাকায় গার্মেন্টে চাকরি করেন।
স্থানীয় বাজারের একটি ছোট কারখানায় তৈরি হাওয়াই মিঠাই পাইকারি হিসেবে কেনেন আবুল কাশেম। পরে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন নানা শহর আর গ্রামে। আর জাতীয় দিবসে ছুটে যান গ্রামীণ কোনো মেলায়। এতে বিক্রিবাট্টাও হয় বেশি। অল্প পুঁজিতে দিনে যা আয় হয়, তাতেই চলে সংসার। তিনি জানালেন, হাওয়াই মিঠাই বিক্রি হয় না, এমন নয়। তবে মুখে পুরে নিমেষেই শেষ হয় বলে অনেকেই পাঁচ টাকা দিয়ে কিনতে চান না। চিনির দাম বেশি হওয়ায় দাম বেড়েছে এ মিঠাইয়েরও।
জয়পুরহাট শহরের জানিয়ার বাগান এলাকার কিশোর তাওহীদ বলে, হাওয়াই মিঠাই খেতে খুব মজা, কিন্তু মুখে দিতেই নেই। তখন আবারও খেতে ইচ্ছে হয়। আর ক্ষেতলাল উপজেলার দেওগ্রামের অছিম উদ্দীন বললেন, তাদের গ্রামের লাঠি খেলার মেলায় প্রতিবছর হাওয়াই মিঠাই এক সময় বিক্রি হতো। তবে ২০-২৫ বছর আগে যেভাবে গ্রামে গ্রামে বিক্রি হতো, এখন আর তা দেখা যায় না। এখনকার অনেক ছেলেমেয়ে হয়তো হাওয়াই মিঠাই খায়ও নি।
আবুল কাশেম এখনো সেই টিনের বাক্স ব্যবহার করেন। তিনদিক কাচ লাগানো এ বাক্সের ভেতরে থরে থরে সাজানো লাল-গোলাপি হাওয়াই মিঠাই। আর এক হাতে থাকে একটা ছোট্ট ঘণ্টা। যেন ঐতিহ্য মেনে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার প্রধান ক্রেতা শিশু-কিশোররা হলেও বড়রাও নেন মাঝেমধ্যে। মেলা আর বিশেষ দিনগুলোতে তাকে দেখেই বাবা-মায়ের কাছে আবদার করে শিশুরা। সেই সুযোগে নিজেদের ছোটবেলার স্মৃতি রোমন্থন করেন তারাও। সন্তানের সঙ্গে ফিরে যান পুরোনো দিনে।