
আসন্ন পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী না থাকায় তিন সিটি নির্ভার আওয়ামী লীগ, দুটিতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ক্ষমতাসীনরা। খুলনা ও রাজশাহীতে শক্ত প্রার্থী না থাকায় জয়ের ক্ষণ গুনছে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে গাজীপুর ও বরিশালে নিজ দলের দ্বন্দ্বে চিন্তায় এবং সিলেটে বিএনপির প্রার্থী অংশ না নেওয়ার ঘোষণায় আপাতত স্বস্তিতে দলটি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সব সিটিতেই জয় চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা, দলের ঐক্য ও বিরোধীদের দুর্বল অবস্থানের কারণে খুলনা ও রাজশাহীতে ফুরফুরে মেজাজে ক্ষমতাসীনরা। নতুন প্রার্থী দেওয়ায় শুরুর দিকে দলের ঐক্য নিয়ে সিলেট সিটিতে চিন্তায় থাকলেও দিন যত যাচ্ছে, প্রার্থীর অবস্থান শক্ত হওয়ায় এই তিন সিটিতেও নির্ভার আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বরিশাল ও গাজীপুরেও নতুন প্রার্থী দেওয়ায় কোন্দল দানা বাঁধে, পাশাপাশি বিরোধী শক্তিশালী প্রার্থী মাঠে সক্রিয়। ফলে বেশ চাপে আছে আওয়ামী লীগ। এজন্য এই দুই সিটিতে কোন্দল নিরসন করে জয় নিশ্চিতে বেশি তৎপরতা দেখাতে হচ্ছে দলটিকে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান
কালবেলাকে বলেন, সব সিটিতেই জনপ্রিয় প্রার্থী দিয়েছি। দুই সিটিতে বর্তমান মেয়রই নৌকার প্রার্থী। তারা উন্নয়ন-অর্জনের মাধ্যমে এলাকায় জনপ্রিয় ও মানুষের আস্থা অর্জনে সফল। এ ছাড়া বাকি জায়গাগুলোতে কিছু কিছু সমস্যা ও দ্বন্দ্ব আছে। তবে নির্বাচনের আগে সব ঠিক হয়ে যাবে, কেন্দ্রীয় টিম কাজ করছে।
জানা গেছে, দলীয় কোন্দল মিটিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্য তৈরি করতে কেন্দ্র থেকে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করে কাজ করছে আওয়ামী লীগ। এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হস্তক্ষেপ করছেন। ইতোমধ্যেই কোন্দলপ্রবণ গাজীপুর ও বরিশাল সিটিতে ২৮ ও ৯ সদস্যের সমন্বয় কমিটি করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের তপশিল অনুযায়ী, ২৫ মে গাজীপুর সিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। খুলনা ও বরিশালে নির্বাচন হবে ১২ জুন। ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচনের ভোট হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোটের মাত্র এক সপ্তাহ বাকি থাকলেও গাজীপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছেন। নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খানের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। ঋণখেলাপির দায়ে প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় জাহাঙ্গীর আলম এ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় মায়ের পক্ষে ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। এরই মধ্যে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ী বহিষ্কারও করা হয়েছে জাহাঙ্গীরকে। গাজীপুরে দ্বন্দ্ব এতটাই তীব্র, আওয়ামী লীগ আগেভাগেই এ কোন্দল নিরসনে ২৮ সদস্যের কেন্দ্রীয় সমন্বয় দল গঠন করে। কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক
এ দলের প্রধান হিসেবে রয়েছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। টিমের সমন্বয়ক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম ও উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হক।
এ বিষয়ে গাজীপুরের সমন্বয় দলের সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ছোটখাটো যে সমস্যা আছে, তা ভোটের আগেই মিটে যাবে। সবখানে দলীয় প্রার্থীরই বিজয়ী হবে। আশা করি, গাজীপুরেও আমরাই জিতব।
বরিশালে সিটিতে প্রতীক বরাদ্দের এখনো ছয় দিন বাকি থাকলেও নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে সেরনিয়াবাত আব্দুল্লাহ; কিন্তু সিটিতে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক কোন্দল ফুঁসে ওঠে, যা প্রকট আকার ধারণ করে। নির্বাচনী প্রচারে প্রার্থীর ভাতিজা বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীদের বাদ দেওয়া, বিভিন্ন দিবসে আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালন দু’পক্ষের সম্পর্ক তিক্ত থেকে তিক্ততর হয়। এমনকি দুই পক্ষের সমর্থকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, হুমকি প্রদান ও সংঘর্ষ পর্যন্ত হয়েছে, যা নিয়ে মামলাও হয়। অবশেষে গত বুধবার দলের সভাপতি শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে প্রার্থীর বড় ভাই ও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহসহ বরিশালের কেন্দ্রীয় নেতাদের একসঙ্গে কাজ করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা মান-অভিমান ভুলে নৌকার প্রার্থীকে জেতাতে দলীয় নেতাদের নির্দেশ দেন। এ উপলক্ষে হাসানাত আব্দুল্লাহকে প্রধান করে একটি টিম গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। সমন্বয়ক হিসেবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও যুগ্ম সমন্বয়ক করা হয়েছে দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেনকে। এ ছাড়া টিমের সদস্য হিসেবে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান, আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ, শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য আনিসুর রহমান ও গোলাম কবীর রাব্বানী চিনু।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘দ্বন্দ্ব নয়, কিছুটা সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, যা নিরসন হয়ে গেছে। বরিশালে নৌকার প্রার্থীই জয়ী হবে।’ যদি কেন্দ্রের এই উদ্যেগেও সংকটের সমাধান না হয় তবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মুফতি সৈয়দ ফায়জুল করিম নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন জেলার নেতারা।
অন্যদিকে, সিলেট সিটিতে নির্বাচনের ৩৪ দিন বাকি থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীই প্রচারে সবার চেয়ে এগিয়ে। এ পর্যন্ত মনোনয়ন কেনা ৮ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে দলীয় প্রতীকের জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীদের প্রচারে খানিকটা গতি থাকলেও বাকি স্বতন্ত্র ৫ প্রার্থীর প্রচার চলছে ঢিমেতালে। নির্বাচনী মাঠ থেকে সিসিকের বর্তমান মেয়র বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরীর হঠাৎ রণে ভঙ্গ দেওয়ায় মাঠের উত্তাপ অনেকটা কমে গেছে। ফলে নির্বাচনী মাঠে আরিফ না থাকায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী অনেকটাই নির্ভার। নৌকার প্রার্থীর পক্ষে দিন-রাত ব্যস্ত সময় পার করছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
এদিকে খুলনা সিটিতে তালুকদার আব্দুল খালেককে নিয়ে একদমই দুশ্চিন্তামুক্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে আরও ৬ প্রার্থী থাকলেও অন্যরা একেবারেই দুর্বল। তা ছাড়া প্রবীণ এই রাজনীতিকের বিরুদ্ধে দলের ভেতরে ও প্রকাশ্য বিরোধী নেই। আওয়ামী লীগের অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশে নির্বাচনী মাঠে তালুকদার খালেকের বিরুদ্ধে কোনো শক্ত প্রতিপক্ষ নেই। ভোটের এখনো তিন সপ্তাহ বাকি থাকলেও জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী আওয়ামী লীগ। খুলনায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে, এমন কোনো শক্ত প্রার্থী নেই এবং আওয়ামী লীগ এই সিটিতে বিপুল ভোটে জয় লাভ করবে বলেও মনে করেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক।
খুলনার মতো রাজশাহী সিটিতেও ফুরফুরে মেজাজে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। কারণ, ভোটযুদ্ধে এখনো তার সামনে কোনো হেভিওয়েট প্রার্থী নেই। এক মাসেরও বেশি সময় বাকি থাকলেও আগেভাগেই প্রচারে নামেন লিটন। নেই দলেরও বিদ্রোহী প্রার্থী। বিএনপির কোনো প্রার্থী নির্বাচনে অংশ না নেওয়া ও ১৪ দলীয় শরিকদের আলাদা প্রার্থী না থাকায় এক প্রকার ফাঁকা মাঠেই গোল দিতে যাচ্ছেন লিটন। বিরোধী হিসেবে পরিচিতরাও নেমেছেন লিটনের নির্বাচনী প্রচারে। আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন, রাজশাহী সদর আসনের এমপি ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশাও দূরত্ব ঘুচিয়েছেন। আপত্তিকর ভিডিও ফাঁসকাণ্ডে বেকায়দায় পড়া মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারও মাঠে নেমেছেন লিটনের পক্ষে। বিএনপিহীন এ সিটি নির্বাচনে আগেভাগেই জয়ের সুবাস পাচ্ছেন লিটন।
দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন কালবেলাকে বলেন, আমাদের প্রার্থীর অবস্থান খুবই ভালো, জয় নৌকার প্রার্থীরই হবে।