
আজ বিশ্ব মা দিবস। প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার দিবসটি পালন করা হয়। এ হিসেবে আজ ১৪ মে রোববার সারা বিশ্বে পালন করা হচ্ছে মা দিবস। প্রতিটি দিনই মাকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার দিন হলেও এ দিবসে মাকে বিশেষভাবে ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা জানানোর দিন।
ধারণা করা হয়, মা দিবসের সূচনা প্রাচীন গ্রিসের মাতৃরূপী দেবী সিবেলের এবং প্রাচীন রোমান দেবী জুনোর আরাধনা থেকে। ইউরোপ ও যুক্তরাজ্য অনেক আগে থেকেই মায়েদের এবং মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট রোববারকে বেছে নিয়েছিল। ষোড়শ শতকে এটি ইংল্যান্ডে মাদারিং সানডে বলে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১৪ সালের ৮ মে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘মা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে।
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘আমার মা অধ্যাপক নাইয়ার সুলতানা একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন। আজীবন শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ইডেন কলেজের বোটানি. বিভাগের প্রধান ছিলেন। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ও মাধ্যমিক শিক্ষার মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্বরত অবস্থায় ২০০৫ সালে মারা যান।
জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে মাকে মনে পড়ে। মা আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মৃত্যুর ১৮ বছর পরেও মায়ের কথা, তার চিন্তা, লালন-পালন, শিক্ষা-দিকনির্দেশনা প্রতিটি বিষয়ই আমার কাছে জাগ্রত। প্রতিনিয়ত দৈনন্দিন যে কাজ আমি করি তার মধ্যে ওই বিষয়গুলো জড়িয়ে রয়েছে। কখনো এই বিষয়গুলো থেকে বেরিয়ে আসিনি। আমার মা নিজেও একজন ক্যারিয়ার ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। একদিকে কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতেন, তেমনিভাবে সংসারেও আমাদের দুবোনকে যথেষ্ট সময় দিয়েছেন। বিশেষ করে আমাদের লেখাপড়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে তদারকি করতেন। আমরা যাতে লেখাপড়াটা ঠিকভাবে করি এ ব্যাপারে খুবই কঠিন ছিলেন। এব্যাপারে আমাদের কখনো ছাড় দেননি। অর্থাৎ সব কিছুর মধ্যেই তার সমতা ছিল। অন্যদিকে মেয়ে হওয়ায় আমাদের কোনো দিক থেকে বঞ্চিত করা হবে এ ধরণের ধ্যান ধারণা তিনি পোষণ করতেন না। আমার মেয়েকে বড় করার ক্ষেত্রেও অনেকটা মায়ের উপর নির্ভরশীল ছিলাম। এ ব্যাপারে মা আমাকে পূর্ণ সহায়তা করেছেন। মায়ের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্ত, কথা সবসময় মনে পড়ে। মায়ের পথ অনুসরণ করেই এগিয়ে চলেছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘মায়ের কাছ থেকে শিখেছি কঠিন সময়ে ধৈর্যের মোকাবিলা করা। অনেক চ্যালেঞ্জ জীবনে আসবে। তা ঠান্ডা মাথায় স্থিরভাবে ধৈর্য্য ধারণ করেও সমাধান করা যায়। এ বিষয়ে তিনি সব সময় গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি নিজেও সেটা পালন করতেন, আমাদেরকেও তা পালন করতে শিখিয়েছেন। কোনো কিছু নিয়ে উত্তেজিত হয়ে যাওয়া, এর মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধান সম্ভব নয় এটাও তিনি আমাদেরকে শিখিয়েছেন। এর পাশাপাশি অপরকে সহযোগিতা করা , বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। মাকে দেখেই আমরা এটা শিখেছি। এরকম অসংখ্য ছোট ছোট বিষয় জীবনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বড় প্রভাব রাখে। এসবকিছু মায়ের কাছ থেকেই শেখা। মা খুব শান্ত প্রকৃতির ছিলেন। মানুষের সঙ্গে নম্র, ভদ্র ব্যবহার দেখানো, ভদ্র আচরণ করা মায়ের কাছ থেকেই ধারণ করেছি। বিশেষ করে বাসায় যারা আমাদের সহযোগিতা করেন তাদের কাজের প্রাপ্য দেওয়া, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, রূঢ় আচরণ না করার নির্দেশ ছিল আমাদের পরিবারে। এখনও সেটা আমি মেনে চলি।
বাংলা একাডেমির সভাপতি ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তার মা মরিয়ম-উন-নেসা বকুল সম্পর্কে বললেন, ‘আমার মা তথাকথিত মায়েদের মতো ছিলেন না। তার কাছে ছেলে বা মেয়ে সন্তান বলে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সন্তানদের লেখাপড়া, খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা সব কিছুই তিনি সমানভাবে দেখতেন। আমার সপ্তম বোনের জন্মের সময় মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভারতেশ্বরী হোমসে কলেজে পড়া বড় বু আর স্কুলে পড়া মেজবু ছুটিতে রাজশাহীতে আসেন। মায়ের অসুস্থতা দেখে তারা মাকে দেখাশোনা করার জন্য ভারতেশ্বরী হোমসের ছুটি ফুরিয়ে গেলেও কয়েকদিন থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এটা শুনে মা তাদের দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, আমার কারণে তোমাদের স্কুল, কলেজ ফাঁকি দিয়ে এখানে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমরা খোলার আগের দিনই হোস্টেলে চলে যাবে। খোলার দিন থেকেই তোমরা ক্লাস করবে।’
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার মা জাহানারা খান সম্পর্কে বলেন, ‘মায়ের সরলতা আমাকে মুগ্ধ করত। ছোটবেলায় মায়ের বিয়ে হয়। মাত্র ১৪ বছর বয়সে আমার জন্ম হয়। স্বামী, তিন ছেলে, আত্মীয়স্বজন, সংসার নিয়ে থাকতেই তিনি বেশি ভালোবাসতেন। পাশাপাশি লেখাপড়াও করেছেন। বাবা মারা যাওয়ার পর ১০ বছর মা আমার সঙ্গেই ছিলেন। কভিডে মাকে হারাই।’