
মার্চ মাসের তৃতীয় শুক্রবার বিশ্বব্যাপী ঘুম দিবস পালন করা হয়। ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব স্লিপ মেডিসিন সুনিদ্রার গুরুত্ব বোঝাতে ২০০৮ সাল থেকে দিনটি পালন করে থাকে। এ বছরের দিনটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে—‘স্বাস্থ্যকর খাবার ও শরীরচর্চার মতোই ঘুমও অত্যাবশ্যকীয়। পরিপূর্ণ ঘুম শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতার মূল ভিত্তি’। ঘুম কেন প্রয়োজন এবং ঘুম না হলে কী করবেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানাচ্ছেন ডা. হেমন্ত রায় চৌধুরী
কখন, কতক্ষণ ঘুম
প্রতিটি মানুষ আলাদা। তাই খাবারের মতো সবার ঘুমের চাহিদাও একরকম হয় না। গবেষকদের মতে, সাধারণত জন্মের পর থেকে এক বছর পর্যন্ত শিশুদের দৈনিক ১২-১৬ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। এক থেকে তিন বছর বয়সী শিশুদের ১১ থেকে ১৪ ঘণ্টা ঘুমানো ভালো। তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের জন্য ১০-১৩ ঘণ্টার ঘুম যথেষ্ট। স্কুলগামী অর্থাৎ ৬-১২ বছরের শিশুদের দিনে ৯-১২ ঘণ্টা ঘুম দরকার হয়। টিনএজারদের জন্য দৈনিক ১০ ঘণ্টা ঘুমের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। আর সুস্থতার জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের দিনে ৬-৮ ঘণ্টা ঘুম চাই। সুস্বাস্থ্যের জন্য রাতজাগা যাবে না। রাত ১১-১২টার মধ্যে বিছানায় যেতে হবে। দিনের ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই দিনের বেলায় কোনো অবস্থাতেই ১৫ থেকে ৪৫ মিনিটের বেশি ঘুমানো যাবে না।
কেন জরুরি
ঘুম রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ঘুম আমাদের মেটাবলিজম সিস্টেম আর ওজন নিয়ন্ত্রণ করে। ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে। হৃদরোগের আশঙ্কা কমায়। সারা দিন কাজ করার পর মস্তিষ্কের বিশ্রাম প্রয়োজন হয়। ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্ক দীর্ঘ আর স্বল্পমেয়াদি স্মৃতিশক্তি গুছিয়ে জড়ো করে রাখে। শারীরিক, মানসিক ও মস্তিষ্কের কার্যক্রম ঠিক রাখার জন্য দিনে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার ঘুমের বিকল্প নেই।
ঘুমের অভাব হলে
ঘুমের অভাবে হার্ট অ্যাটাক, হার্টের নানা অসুখ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিসের মতো রোগের আশঙ্কা থাকে। ঘুমের অভাব হলে শরীরে কার্টিসল নামের একটা হরমোনের নিঃসরণ হয়। এটা ত্বকের কোলাজেন ভেঙে ফেলে। ফলে ত্বকের লাবণ্য কমে যায়। কম ঘুমানোর সঙ্গে অবসাদগ্রস্ততার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ভুলে যাওয়া রোগ, ডিপ্রেশন, সবসময় ক্লান্ত থাকা, মেজাজ খিটখিটে হওয়ার মতো সমস্যার মূলে থাকতে পারে ঘুমের অভাব।
ভালো ঘুমের জন্য
l সুস্বাস্থ্যের জীবনাচরণগুলো একটার সঙ্গে অন্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই স্বাস্থ্যকর খাবার এবং শারীরিক ব্যায়াম না করলে ভালো ঘুমের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তাই সবার আগে সময়মতো পুষ্টিকর খাবার চাই। এরপর শরীরকে কার্যক্ষম রাখতে ব্যায়াম হতে হবে জীবনের দ্বিতীয় সঙ্গী।
l রাতের খাবার হতে হবে হালকা এবং সহজপাচ্য। বেশি চর্বিযুক্ত ভারী খাবার, যা হজমে ব্যাঘাত ঘটায়, তা খাওয়া যাবে না। ঘুমের আগে হালকা ব্যায়াম করে নিন। মেডিটেশন বা ধ্যানও ভালো ঘুমের জন্য বেশ কার্যকর।
l খাবারের মতো ঘুমেরও রুটিন থাকা চাই। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যেতে হবে। ঘুমের অন্তত দুই ঘণ্টা আগে রাতের খাবার শেষ করতে হবে। সন্ধ্যার পর চা বা কফি পান করা যাবে না। সিগারেট বা অ্যালকোহলও সুনিদ্রার অন্তরায়। অনেকের ক্ষেত্রে এসবে সাময়িক নিদ্রাভাব হলেও তা গভীর ও পরিপূর্ণ ঘুম হয় না।
l ঘুমের আগে দমচর্চা করুন নিয়মিত। শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার একটা পদ্ধতি আছে। পদ্ধতির নাম ৪-৭-৮। ৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে নাক দিয়ে শ্বাস নিন। ৭ সেকেন্ড দম আটকে রাখুন। এরপর ৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন। এটাকে শ্বাসের ব্যায়াম বলে। এভাবে কিছুক্ষণ করলেও ঘুম আসবে।
l মোবাইল ফোন, টিভি, কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে স্বল্প তরঙ্গের যে নীল আলো নিঃসৃত হয়, এই আলো আমাদের শরীরের ঘুমের হরমোন মেলানটোনিন নিঃসৃত হতে বাধা দেয়। তাই বিছানায় শোবার আগেই সব ধরনের স্ক্রিন বন্ধ করে দিতে হবে।
লেখক : নিউরোরেডিওলোজিস্ট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স, ঢাকা