
মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত, প্রার্থিতা বাতিল এবং নিজ দল আওয়ামী লীগ থেকে এবার স্থায়ী বহিষ্কার হওয়ার পর নিজের ক্ষোভ ও দুঃখের কথা জানালেন গাজীপুর সিটির সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, মেয়র হওয়ার পর দলমত নির্বিশেষে সবার জন্য কাজ করেছি। কিন্তু মাত্র তিন বছর দায়িত্ব পালন করার পর আমাকে মেয়রের পদ থেকে সরানো হয়। পেশিশক্তি বলেন, আদালত বলেন—সব জায়গায় শক্তি প্রয়োগ করে আমাকে আর সিটি করপোরেশনে বসতে দেওয়া হয়নি। নীতি এবং আদর্শের জায়গা থেকে আমি পাঁচ বছরের জন্য শপথ নিয়েছি। ন্যায়বিচারের জন্য আদালত পর্যন্ত গিয়েছিলাম। কিন্তু আদালত থেকেও ন্যায়বিচার পাইনি।
জাহাঙ্গীর আলমকে আওয়ামী লীগে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রায় পাঁচ মাস পর গত সোমবার সন্ধ্যায় আবারও দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে। এক দিন পর গতকাল মঙ্গলবার নিজ বাসায় এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের ছয় বছর সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। ২০১৮ সালে আমাকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছিলাম। মেয়র হিসেবে আওয়ামী লীগসহ নগরের সবার জন্য কাজ করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে আমি এ শিক্ষাই পেয়েছি।
এর আগে জাহাঙ্গীর আলমের একটি কথোপকথনের ভিডিওর সূত্র ধরে ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। পরে শর্তসাপেক্ষে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হলেও মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। পরে তিনি ও তার মা জায়েদা খাতুন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। মায়ের প্রার্থিতা বৈধ হলেও ঋণখেলাপির কারণে জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা বাতিল হয়। এরপর থেকে জাহাঙ্গীর আলম তার মায়ের টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে ব্যাপক প্রচার শুরু করেন। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বিজয় অনিশ্চয়তায় ফেলে দেন।
দল থেকে বহিষ্কার থাকার সময়ের স্মৃতিচারণ করে সাবেক এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, দীর্ঘ ১৮ মাস প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির সব নেতার বাসায় গিয়েছি, অফিসে গিয়েছি। সবাইকে বিষয়টি বলেছি, যোগাযোগ করেছি। তাদের অনুরোধ করেছি, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আপনারা বিষয়টি বলুন, না হয় সত্য বলার জন্য একটা সুযোগ করে দেন। সবাই বলেছেন, তুমি কোনো অন্যায় করোনি, তোমার সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জানি না প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার বিষয়ে কেউ কিছু বলেছিল কি না!
একজন আওয়ামী লীগ নেতা ও মেয়র হওয়ার পরও তার কথা কেউ শোনেনি বলে দুঃখ প্রকাশ করেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, সারা দেশে ১৬ কোটি মানুষ, সেখানে গাজীপুর মহানগরে ৪০ লাখ মানুষের বসবাস। ১২ লাখ ভোটারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি (মেয়র) ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কথা শোনার দুই মিনিট সময় হয়নি প্রধানমন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদকের। আমার জন্য কথা বলার কোনো পথ তৈরি করে রাখা হয়নি। শুধু আমার বিরুদ্ধে নালিশ গিয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, যারা আমার বিরুদ্ধে নালিশ দিয়েছেন, তারা এই জায়গায় এক কথা বলেছেন; আর প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরেক কথা বা তথ্য দিয়েছেন।
দীর্ঘ ১৮ মাস চোখের পানি ফেলার কথা জানিয়ে বহিষ্কার হওয়া এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, সব ষড়যন্ত্রের মধ্যে থেকেও আমি চেয়েছিলাম সত্যটা প্রতিষ্ঠিত হোক। সেই পথ তৈরি করে রাখা হয়নি। শুধু আমার বিরুদ্ধে নালিশই গিয়েছে। দীর্ঘ ১৮ মাস আমি চোখের পানি ফেলেছি। আজকে আর চোখের পানি ফেলব না।
জাহাঙ্গীর আলম আহ্বান জানান, আজকে গাজীপুরে এসে দেখেন, লাখ লাখ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি একসঙ্গে হয়ে গাজীপুরে ভোট করতে আসছে। যেখানে আপনারা যুদ্ধ করতে আণবিক বোমা ব্যবহার করছেন, এখানে আণবিক বোমার কোনো দরকারই ছিল না। আমি, আমার মা এবং আওয়ামী লীগ যদি এক হয়ে কাজ করতাম, তাহলে কেন্দ্রীয় নেতাদের গাজীপুরে আসতে হতো না। আমার নেতাদের বাসায় বাসায় যেতে হতো না। প্রশাসনের লোক যারা টেবিল ঘড়ির নির্বাচন করছেন, তাদের বাসায় যাচ্ছেন। হুমকি দিচ্ছেন, এতে কি আপনারা আপনাদের সন্তানের মুখে বিষ ডেলে দিচ্ছেন না? আমি কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। আপনারা নেত্রীকে সত্যটা জানান, উনি সত্যটা জানুক, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর ওপর হয়রানি করা হচ্ছে, অবিচার করা হচ্ছে।
মায়ের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া সম্পর্কে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার মা এসব অন্যায়ের প্রতিবাদস্বরূপ এখানে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। সন্তান হিসেবে আমি আমার মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমার মা বলেছেন, তুমি যদি অন্যায় কিছু করো, এর বিচার এই শহরের মানুষ আগামী ২৫ তারিখ ভোটের মাধ্যমে করবে।
আওয়ামী লীগের প্রতি ভালোবাসার কথা জানিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আওয়ামী লীগ আমার ভালোবাসার জায়গা। প্রধানমন্ত্রী আমার শ্রদ্ধার জায়গা। এখানে আজমত উল্লা খানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এই আজমত উল্লাই আমার ক্ষতি করার মূল পরিকল্পনায় জড়িত ছিল। আজমত উল্লা আমার বাসায় এসে খেয়েছে। এই বাসায় বসে বসেই ক্ষতিগুলো করেছে। তাই আমার মা বলেছেন, ‘তুমি আজমত উল্লার ভোটে যাইবা না, তুমি আমার ভোটে থাক। এখন আপনারাই বলেন, আমি কি আজমত উল্লার সঙ্গে থাকব? না আমার মায়ের পাশে থাকব?’
কেন্দ্রীয় নেতাদের গাজীপুরে দাওয়াত দিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আপনারা গাজীপুরে আসেন, দাওয়াত খেয়ে যান। কর্মীদের হুমকি দিয়েন না, হয়রানি করবেন না। নির্বাচন কমিশন চাচ্ছে একটি সুষ্ঠু সুন্দর ভোট করতে, সরকারও চাচ্ছে সুন্দর ভোট হোক। কিন্তু ভোট দিতে গিয়ে যদি এক ভাইয়ের সঙ্গে আরেক ভাইয়ের মারামারি করান, পেশিশক্তি ব্যবহার করেন, তা হলে নির্বাচন না করে সরাসরি ডিক্লার করে নিয়ে যান।
জাহাঙ্গীর আরও বলেন, আমার আওয়ামী লীগে কোনো পদে নেই। আমার সদস্য পদও আওয়ামী লীগে নেই। আমি আওয়ামী লীগের একজন সাধারণ সমর্থক। একজন সাধারণ সমর্থককে বহিষ্কার করতে আপনাদের কেন কেন্দ্রীয় কমিটি লাগবে। তিনি পার্টির কাছে আবেদন করেন, আমাকে পার্টির সমর্থক হিসেবে থাকতে দেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক দলের (নৌকার) বিরুদ্ধে গিয়ে গত উপজেলা নির্বাচনে মিছিলসহ গণসংযোগের বিষয়েও কথা বলেন। কিন্তু দল তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলেও উল্লেখ করেন। এ সময় স্বতন্ত্র (টেবিল ঘড়ি) প্রার্থী জায়েদা খাতুন পাশেই ছিলেন।
মিডিয়া ও সাংবাদিকদের নিরপেক্ষতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশনের আহ্বান জানিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কিছু কিছু সাংবাদিককে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করার জন্য বলা হয়েছে। তিনি বলেন, আপনাদের মাধ্যমে মানুষ যেন সত্যটা জানতে পারেন। আমি চাই প্রধানমন্ত্রী মিডিয়ার মাধ্যমে সত্যটা জানুক।