বনমন্ত্রীর এলাকায় বন পুড়ছে আট দিন

বন কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের যোগসাজশে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় পাহাড়ে দেওয়া হয়েছে আগুন। এতে পুড়েছে প্রায় ৪০ হেক্টর এলাকার গাছ।
বন কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের যোগসাজশে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় পাহাড়ে দেওয়া হয়েছে আগুন। এতে পুড়েছে প্রায় ৪০ হেক্টর এলাকার গাছ।ছবি : কালবেলা

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের নির্বাচনী এলাকা মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি ও বড়লেখা উপজেলা। এই দুই উপজেলায় অবস্থিত পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট। এর মধ্যে মন্ত্রীর নিজ উপজেলা বড়লেখা রেঞ্জের মধ্যে থাকা সমনভাগ সংরক্ষিত বনের আয়তন ১ হাজার ৮৫০ হেক্টর। ছোট-বড় পাহাড় এবং টিলায় বনের মধ্যে বাড়তি সৌন্দর্য যুক্ত করেছে। রয়েছে নানা ধরনের বন্যপ্রাণী এবং পশুপাখি। অবাক হলেও সত্য, কয়েক দিন ধরে এই বন আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রায় ৪০ হেক্টর এলাকা বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়েছে। স্থানীয় বন কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালীদের যোগসাজশে এমন ঘটনা ঘটলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। উল্টো বন কর্মকর্তারা সাফাই গাইছেন বন ধ্বংসের পক্ষে।

স্থানীয়রা জানান, পাথারিয়া প্রাকৃতিকভাবে সাজানো-গোছানো একটি বন ছিল। তবে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী এবং অসাধু বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অবাধে চলছে বৃক্ষনিধন। নানা ধরনের বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল ছিল এ বন। এক সময় এই বনে হাতি এবং মায়া হরিণের অবাধ বিচরণ ছিল। বন কাটা শুরু হওয়ার পর থেকে হাতি এবং হরিণগুলো চলে গেছে।

স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পরিবেশগতভাবে মিশ্র চিরসবুজ সমনভাগ বনাঞ্চলের এ অংশটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের একটি অংশ এবং এটি ভারত-বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্তব্যাপী ছয়টি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যকার একটি। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ওই সমনভাগ বনাঞ্চলে প্রায় ৬০৩ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং উভচর সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপ্রায়ী প্রাণীর সমন্বয়ে মোট ২০৯ প্রজাতির মেরুদণ্ডী বন্যপ্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ২০ প্রজাতির উভচর, ৪৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ১১৩ প্রজাতির পাখি ও ৩১ প্রজাতির স্তন্যপায়ীসহ অসংখ্য বিরল এবং বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র। সমনভাগ বনাঞ্চলটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মিলে চিরসবুজ একটি বনাঞ্চল এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্য রক্ষায় বাংলাদেশের মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অবস্থান অন্যতম।

জানা যায়, বিভিন্ন সংরক্ষিত বনে সামাজিক বনায়নের করছে বন বিভাগ। সেখানে আকাশমণি, আগর গাছের চারা রোপণ করা হয়। বন বিভাগের বিটের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা সর্দারের মাধ্যমে হেক্টরপ্রতি ৩০-৪০ হাজার টাকা করে নেন। বিনিময়ে একজন ব্যক্তি বন বিভাগের ১ হেক্টর সংরক্ষিত বনের জায়গার গাছ দেখাশোনা করবেন এবং এসব গাছ বিক্রির ৪০ শতাংশ টাকা তারা পাবেন। স্থানীয় অনেকেই বলছেন, আগুন লাগার বিষয়টি স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী জানতেন। তাই তারা শ্রমিকদের মাধ্যমে বাঁশ এবং গাছ কেটে নিচ্ছেন। এরপর এসব স্থানে বৃক্ষহীন দেখিয়ে সামাজিক বনায়ন করা হবে। এতে লাভবান হন স্থানীয় প্রভাবশালী এবং বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা। এরই অংশ হিসেবে হয়তো সমনভাগের এ সংরক্ষিত বনে আগর বাগান করবে বন বিভাগ। এ কারণেই বন কর্মকর্তাদের চোখের সামনে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে বাঁশ ও বনের গাছ পরিষ্কার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। সংরক্ষিত এ বনে আগুন লাগার ফলে মারা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ফলে হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশের ভারসাম্য।

সরেজমিন বনে দেখা যায়, সমনভাগ বিটের দলছড়ি ও মাকাল জোরা এলাকায় রয়েছে ছোট-বড় অনেক পাহাড়। এসব পাহাড়ের প্রায় ৪০ হেক্টর বন আগুনে পুড়ে গেছে। মারা যাচ্ছে বনে থাকা বিভিন্ন ধরনের পশুপাখি, পোকামাকড় ও জীবজন্তু। আগুনে পুড়ে অজগর, চশমাপরা হনুমান, মায়া হরিণ, কচ্ছপ, বনরুই, সজারুসহ বিভিন্ন সরীসৃপ প্রজাতির বিরল কীটপতঙ্গ মারা গেছে। তবে এক পাশ আগুনে পুড়লেও অন্য জায়গাগুলোতে চলছে বাঁশ কাটা। অন্তত ২০ শ্রমিক এসব বাঁশ কাটছেন। তবে তারা কার নির্দেশে বাঁশ কাটছেন, তা কেউই বলতে চাননি।

স্থানীয় বেশ কয়েকজন বলছেন, কয়েকদিন ধরেই বনে আগুন জ্বলছে। আমরা আগুন দেখার পর পরই বন বিভাগকে জানিয়েছি। কিন্তু বন বিভাগের কর্মকর্তারা বিষয়টিকে আমলে নিচ্ছেন না।

পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিমের একজন সদস্য পরিবেশকর্মী খুরশেদ আলম বলেন, একটি বন কেউ তৈরি করতে পারবে না; কিন্তু ধ্বংস করা যায় খুব সহজ। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছপালা, লতাপাতা হচ্ছে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। এগুলো যখন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে, তখন প্রাণীগুলো কোথায় যাবে? বন বিভাগের উচিত এ রকম গভীর বনকে প্রাকৃতিকভাবে রাখা। এখানে বনায়ন করলে বন থাকবে না। বন্যপ্রাণী এখন হুমকির মুখে। অচিরেই হারিয়ে যাবে এখানকার সব বন্যপ্রাণী।

এ বিষয়ে সমনভাগ বিট কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. নুরুল ইসলাম বলেন, উপকারভোগীদের মাধ্যমে ২০ হেক্টর জায়গায় একটি আগর বাগান করা হবে। সেজন্য বন কেটে পরিষ্কার করা হচ্ছে। আগুন লাগার ব্যাপারটি এখানে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। হয়তো কেউ বিড়ি খেয়েছে এখানে। আর এটা থেকেই আগুন লেগে বনের চার-পাঁচ হেক্টর পুড়ে গেছে।

বড়লেখা রেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর রঞ্জন দাস বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সিলেট বন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তৌফিকুল ইসলাম বলেন, আমি খবর পেয়েছি। যে কোনো অসাবধানতায় হয়তো এ আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। ঝোপঝাড়, গাছের ডালপালা কাটা হয়েছে। সেজন্য এখানে আগুন লেগে এ এলাকা পুড়ে গেছে। আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছি। আমার স্টাফ আগামীকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আমি বনে আগুন লাগার বিষয়টি জেনেছি। যেহেতু সংরক্ষিত বন এলাকায় আগুন লেগেছে এতে সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, পাখির বাসার ব্যাপক ক্ষতি হবে।

এ বিষয়ে প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমির হোসেন চৌধুরী বলেন, আমি সংরক্ষিত বনে আগুন লাগার বিষয়টি জানতাম না। আপনার মাধ্যমে বিষয়টি অবগত হয়েছি। এই বিষয়ে সিলেট ডিভিশনের ডিএফওকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেব।

এ বিষয় জানতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। পরিচয় জানিয়ে মেসেজ দেওয়া হলেও তিনি কল করেননি।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com