
নওগাঁর মৌমাছির চাকের গ্রাম। মূলত দুটি গ্রামকে মানুষ চেনে এই নামে। এখানকার ঘরের দেয়াল, বারান্দা, ছাদের কার্নিশ, গাছের ডালসহ বাড়ির আনাচে-কানাচে দেখা মেলে অসংখ্য মৌচাকের। চারপাশে উড়ছে হাজারো মৌমাছি। পাশ দিয়েই বাড়ির বাসিন্দারাও চলাফেরা করছেন নিশ্চিন্তে। কোনোদিন মৌমাছির কামড় খেতে হয়নি তাদের। খাঁটি মধু সংগ্রহ করতে এখানে নিয়মিত ছুটে আসছেন আশপাশের এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের শত শত দর্শনার্থী। তাদেরও কোনো সমস্যা হয়নি কোনোদিন। এ যেন মৌমাছি আর মানুষের এক অনন্য মিতালি।
সাধারণত মৌমাছি দেখলেই মানুষ কিছুটা আতঙ্কে ভোগে। ভাবে, পাছে না হুল ফুটিয়ে বসে; কিন্তু নওগাঁর মান্দা উপজেলার পরানপুর ইউনিয়নের পীরপালি ও ফেটগ্রামে চোখে পড়ল পুরোপুরি ভিন্ন দৃশ্য। এই দুই গ্রামের শতাধিক পরিবারের ভাগ্য বদলে দিয়েছে প্রাকৃতিকভাবে মৌ-চাষ। তাদের অধিকাংশের আয়ের একমাত্র পথ এখন এটি। এখানকার একেকটি বাড়িতে রয়েছে শতাধিক মৌচাক। এ কারণেই গ্রাম দুটি বেশি পরিচিত মৌমাছির চাকের গ্রাম নামে। আর সেই চাক থেকে নিজ চোখে দেখে খাঁটি মধু সংগ্রহ করতে প্রতিদিনই শতাধিক দর্শনার্থী ভিড় করছেন বাড়িগুলোতে।
সরেজমিন দেখা যায়, পীরপালি এবং ফেটগ্রামের অধিকাংশ মৌচাষিই কাজে লাগিয়েছেন নিজের বাড়িকে। ঘরের দেয়াল, বারান্দা, ছাদের কার্নিশ, গাছের ডাল সবখানেই আবাসস্থল গড়ে তুলেছে মৌমাছির দল। সরিষা চাষের মৌসুমে এই মৌচাকগুলোতে চলে আসে, মৌসুম শেষে আবার অন্যত্র চলে যায় অধিকাংশ মৌমাছি। সে হিসেবে অন্তত ছয় মাস মৌমাছির সঙ্গে বাড়ি ভাগাভাগি করে থাকেন তারা।
পীরপালি গ্রামের মাস্টার হাফিজ উদ্দিন বলেন, প্রায় ২৫-৩০ বছর ধরে এভাবেই চাক থেকে মধু সংগ্রহ করে আসছে দুই গ্রামের পরিবারগুলো। সরিষা মৌসুমে মৌমাছি এসে পছন্দমতো বাড়ির বিভিন্ন স্থানে মৌচাক তৈরি করে। আবার অধিকাংশই মৌসুম শেষে চলে যায়। বাকিগুলো থাকে বছরজুড়ে।
সাধারণত এক একটি মৌচাক থেকে একাধিকবার মধু সংগ্রহ করা যায়। প্রতি মৌসুমে মৌচাকের মধু নামের একটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান এই মধু সংগ্রহ করে। মাঝেমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মধুপ্রেমীদের নিয়ে আসে প্রত্যক্ষভাবে চাক থেকে সংগ্রহ করা খাঁটি মধু খাওয়া ও কেনার জন্য। প্রতি কেজি মধু বিক্রি হয় ৫০০-৬০০ টাকায়।
রাজশাহী থেকে আসা দর্শনার্থী রকিবুল হাসান বলেন, মৌমাছি আর মানুষের একসঙ্গে এমন বসবাস আগে কখনো দেখিনি। অবাক করার মতো বিষয়। খুবই ভালো লেগেছে। আর প্রাকৃতিক এই মধু সত্যিই খুব সুস্বাদু। যে কেউ চোখবন্ধ করে এ মধু সংগ্রহ করতে পারেন। মৌচাক মধু কোম্পানির প্রোপ্রাইটর আব্দুর রহিম বলেন, গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে প্রায় ৩০-৫০টি মৌচাক রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার মৌচাকের সঙ্গে বসবাস করে আসছেন গ্রামবাসী। এ মধু সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করা হচ্ছে। এ অর্থ দিয়েই স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চালাচ্ছেন তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এ কে এম মনজুরে মাওলা বলেন, চলতি সরিষা মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি মধু সংগ্রহ করা হয়েছে। আর এই মধু সংগ্রহ করতে আগ্রহী কৃষকদের কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে মৌ বাক্স প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া বাহিরে থেকে মৌয়ালদের নওগাঁয় এসে মধু সংগ্রহ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, যার কারণে এ মধু সংগ্রহ করতে নতুন করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হয়েছে অনেক বেকারের।