কোকিলমণির রসপায়ী বানর

সুন্দরবনের কোকিলমণিতে খেজুরের রস পানরত বানর।
সুন্দরবনের কোকিলমণিতে খেজুরের রস পানরত বানর।ছবি : নুসরাত জাহান

বাঘ মামার সন্ধানে তিন দিন ধরে সুন্দরবনের বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুরছি। আন্ধারমানিক, হরিণটানা, সূপতি, কচিখালী, ডিমের চর, কটকা, জামতলী শেষ করে তৃতীয় দিন রাতে অনিন্দ্য সুন্দর কোকিলমণিতে ছোট্ট লঞ্চ গাঙচিল নোঙর করল। চতুর্থ দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভারি কুয়াশায় এক ফুট দূরের কিছুও দেখা যাচ্ছে না। ঘণ্টা দুয়েক পর সকাল পৌনে ৯টার দিকে কুয়াশা কাটলে নৌকা নিয়ে পাশের আগুনজ্বলা খালে (মতান্তরে খেতখেরা বা মাছরাঙা খাল) প্রবেশ করলাম। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ঘোরাঘুরি করেও মামা দূরে থাক বিরল ও দুর্লভ কোনো পাখিরও দেখা পেলাম না।

সকাল ১১টায় লঞ্চে ফিরে নাশতা সারলাম। খবর পেলাম কোকিলমণি স্টেশনের মিঠা পানির পুকুরে মামা পানি পান করতে আসে। বন বিভাগের কেউ কেউ দেখেছেন। ঠিক ১২টায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকার প্রয়াসে।

পুকুরটি লাল শাপলায় যেন ছেয়ে আছে। পুকুরপাড়ে বেশ কিছু খেজুরগাছ, যার বেশকটি রসের জন্য কাটা হয়েছে। প্রথমেই পুকুরের চার পাড়ে একটা চক্কর দিলাম; কিন্তু ওখানকার বনকর্মীরা ঘাট থেকে দূরে যেতে না করল। কারণ, মামার কোনো বিশ্বাস নেই, কোথায় ঘাপটি মেরে আছে কে জানে? তাই বাকি সময় ঘাটের পাশেই বসে রইলাম। যখন থেকে বসেছি, তখন থেকেই দেখছি হরিণ, শূকর, শঙ্খচিল, তুর্কী বাজ, দাঁড়কাক, ঘুঘু ও নানা প্রজাপতির পাখি-প্রাণী পুকুরে এসে পানি পান করছে। হরিণ আর শূকররা তো ফুলসহ শাপলাগাছই খেয়ে নিচ্ছে। কিছু ছোট পাখি মাঝেমধ্যে খেজুরগাছের কাটা অংশ থেকে মিষ্টি রসের স্বাদ নিচ্ছে। আমরা প্রতিটি দৃশ্যই ক্যামেরা বন্দি করছি। আর চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছি—মামা আসে কিনা দেখার জন্য। তবে এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। আসলে ডাঙায় মামার দেখা না পাওয়াই ভালো। লঞ্চ বা নৌকা থেকে দেখলে ঝুঁকি কম।

ঘাটে বসার প্রায় পৌনে ৪ ঘণ্টা পর একটি বানরকে পুকুরপাড়ে আসতে দেখলাম। ভাবলাম সে-ও বোধহয় পানি পান করবে। হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বড় পুকুরে সবসময় তাদের পানি পান করতে দেখি; কিন্তু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পানি পান না করে হঠাৎ এক লাফে পাশের খেজুরগাছে উঠে পড়ল। আর সুমিষ্ট রসে গলা ভেজাতে লাগল। আমাদের ক্যামেরার শাটারও থেমে থাকল না। পাশে বসে থাকা স্ত্রী নুসরাতও বেশ ভালো ছবি তুলল। মামার আশায় দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা বসে থেকেও কোনো ক্লান্তি বা হতাশাবোধ করলাম না অন্যান্য বন্যপ্রাণীর আনাগোনা ও কিছু রসাত্মক কার্যকলাপের জন্য।

আমাদের চিরচেনা স্তন্যপায়ী প্রাণী বানর। বাঁদর, বান্দর, লাল বান্দর বা কোটা বান্দর নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম রেসাস মেকাক, রেসাস মাঙ্কি বা ইন্ডিয়ান রেসাস মেকাক। Cercopithecidae গোত্রের বানরের বৈজ্ঞানিক নাম Macaca mulata। দেশব্যাপী বিভিন্ন পরিবেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত এবং সচরাচর দৃশ্যমান হলেও দিন দিন ওদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তাই বর্তমানে এ দেশে ওরা শঙ্কাগ্রস্ত প্রাণী হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ ছাড়াও আফগানিস্তান, ভুটান, চীন, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে ওদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।

বানর প্রাইমেট বর্গের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত মুখ। প্রাপ্তবয়স্ক বানরের দেহের দৈর্ঘ্য ৪৫ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার ও লেজ ১৯ থেকে ৩১ সেন্টিমিটার। আর ওজন ৩ থেকে ১১ কেজি। মুখমণ্ডল লোমহীন ও হালকা গোলাপি বা লালচে। দেহের ওপরটা ধূসর-বাদামি থেকে লালচে-বাদামি ও নিচটা সাদাটে-ধূসর থেকে হালকা বাদামি। নিতম্বের চামড়া লালচে। মাঝারি আকারের লেজটি কিছুটা দাঁড়িয়ে থাকে। পুরুষ স্ত্রীর থেকে আকার ও ওজনে বড় হয়।

বানর ঢাকা ও অন্যান্য শহরসহ দেশের সব ধরনের বনে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। তবে খোলা প্রান্তর ও গভীর বনে জলাশয়ের আশপাশের গাছে বেশি দেখা যায়। ওরা দিবাচর, ভূমিচারী ও বৃক্ষবাসী। বানর সামাজিক প্রাণী; বহু পুরুষের নেতৃত্বে ১০ থেকে ৯০টির দলে বাস করে। মূলত ফল, পাতা, কুঁড়ি, ফুল, মূল, শস্যদানা ইত্যাদি খায়। তবে অমেরুদণ্ডী প্রাণী ও ছোট মেরুদণ্ডী প্রাণীও খেতে পারে। প্রায়ই দল বেঁধে শস্যক্ষেত ও বাগানে হানা দেয়।

ওরা সারা বছর প্রজনন করতে পারে; তবে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরই বেশি। স্ত্রী ১৩০ থেকে ১৮০ দিন গর্ভধারণের পর একটি বাচ্চা প্রসব করে। পুরুষ চার ও স্ত্রী তিন বছরে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। আয়ুষ্কাল ১২ বছর, তবে ১৫ থেকে ২৫ বছরও বাঁচতে পারে। আগেই বলেছি, ওরা দেশের সব এলাকায় বিস্তৃত হলেও বর্তমানে শঙ্কাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। কাজেই ওদের রক্ষার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

লেখক : অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com