রাজন ভট্টাচার্য
প্রকাশ : ১৩ মে ২০২৩, ০৮:৫৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পাঁচ বছরে বন্ধ শতাধিক ট্রেন

পাঁচ বছরে বন্ধ শতাধিক ট্রেন

ময়মনসিংহ-মোহনগঞ্জ পর্যন্ত প্রতিদিন তিনটি লোকাল ট্রেন চলাচল করত। সুনামগঞ্জের বেশিরভাগ উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ ভালো থাকায় ভাটি বাংলার রাজধানী হিসেবে পরিচিত নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ। শহরে যাতায়াতের জন্য এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান বাহন ছিল ট্রেন। সম্প্রতি একটি ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে স্থানীয়দের। যে দুটি ট্রেন চলছে, তারও সময় ঠিক থাকে না। লাইট, বাথরুম, ফ্যানসহ সেবা বলতে কিছু নেই। একাধিক স্টেশনে ট্রেন থামলেও নেই টিকিট। বিনা টিকিটে ভ্রমণ করেন অনেক যাত্রী। সব মিলিয়ে নামেমাত্র ট্রেন চলাচল করছে প্রায় ৮০ কিলোমিটারের এই রেলপথে। রেলওয়ের বাণিজ্য বিভাগ থেকে জানা গেছে, রেলপথের উন্নয়নের মহাসমারোহের মধ্যেও গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন রুটে বন্ধ হয়ে গেছে ১০৫টি লোকাল ট্রেন। এতে রেলের আয় কমে দিন দিন লোকসান বাড়ছে।

করোনা মহামারির আগে চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে প্রতিদিন যাত্রী পরিবহন করত জালালাবাদ এক্সপ্রেস। মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও ফেনীর ওপর দিয়ে চলাচল করা এই এক্সপ্রেস ট্রেনটি ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর বন্ধ করে দেয় রেলওয়ে। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সাময়িক বন্ধের কথা বলা হলেও পরে আর ট্রেনটি চালু করেনি কর্তৃপক্ষ। এতে বিপাকে পড়েন স্বল্প খরচে ট্রেনটিতে যাতায়াত করা শত শত যাত্রী। ঢাকা-কিশোরগঞ্জগামী ঈশাখাঁ এক্সপ্রেসও বন্ধ দীর্ঘদিন। যাত্রী চাহিদা থাকলেও কবে এই লোকাল ট্রেনটি চালু হবে, কেউ জানে না।

কর্তৃপক্ষ বলছে, মূলত ইঞ্জিন, বগিসহ লোকমাস্টার সংকটের কারণেই বন্ধ হওয়া ট্রেনগুলো চালু হচ্ছে না। তবে এ নিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করা হচ্ছে। গুরুত্ব বিবেচনায় পর্যায়ক্রমে এসব ট্রেন চালুর কথা জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রেলের নজর এখন নতুন নতুন রুটে আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা ও বড় বড় প্রকল্প নেওয়া। চলমান প্রকল্পগুলোর প্রতিও নজর বেশি। লোকাল সার্ভিসের প্রতি নজর সরে যাওয়ার কারণেই প্রতিষ্ঠানের লোকসানের বোঝা বাড়ছে।

মূলত লোকাল ট্রেনগুলো ছিল স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের যোগাযোগের প্রধান বাহন। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই ট্রেনগুলোর ব্যাপক ভূমিকা। প্রান্তিক চাষিরা তাদের উৎপাদিত ফসল কিংবা কৃষিপণ্য ট্রেনে করে শহরে নিয়ে যেতেন বাড়তি দামের আশায়। সারা দেশে শতাধিক ট্রেন বন্ধ হওয়ায়, চিকিৎসা, শিক্ষা, কৃষিপণ্য, ক্ষুদ্র ব্যবসা নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা বিশ্বেই স্বল্পদূরত্বের ট্রেন সার্ভিস জনপ্রিয়। অথচ দেশে এসব ট্রেন একের পর এক বন্ধ হওয়ায় এই বিভাগে দিন দিন লস বাড়বে। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেনের বা নতুন নতুন প্রকল্প থেকে নজর সরিয়ে পুরোনো রুটগুলো সচল করা ও বন্ধ স্টেশন চালুর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

রেলে সব মিলিয়ে ৩৫৯টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেনের সংখ্যা ১০৪টি। ঢাকা-কলকাতা পথে চলে চারটি ট্রেন। বাকি সবকটি মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের ৭৫ ভাগ যাত্রীই বহন করে লোকাল ট্রেন। অথচ রেল কর্তৃপক্ষের বেশিরভাগ মনঃসংযোগই যেন দূরপাল্লার ট্রেনকে ঘিরে। করোনা মহামারির প্রকোপ কমলে ও বন্ধ লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেন।

লোকাল ট্রেন বন্ধ হওয়ায় স্থায়ীভাবে বন্ধ হতে বসেছে শতাধিক রেলস্টেশন। কারণ এসব স্থানীয় স্টেশনগুলোতে কোনো আন্তঃনগর ট্রেন থামে না। লোকাল ট্রেন বন্ধ হওয়ায় চাপ বেড়েছে আন্তঃনগরে।

ফলে ভোগান্তির শেষ নেই প্রান্তিক মানুষের।

জানা গেছে, ১০ বছরে রেলের উন্নয়নে খরচ হয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। বুলেট ট্রেন চালানোর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে খরচ হয়েছে ১১০ কোটি টাকা। মহাসমারোহে চলছে রেলের উন্নয়ন, ৩৮টি উন্নয়ন প্রকল্প; যার সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা।

রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত বছর রেল উন্নয়ন খাতে খরচ করেছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। এ খরচের প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকাই খরচ হয়েছে লাইন নির্মাণ ও ইঞ্জিন-কোচ কেনায়, যার প্রায় পুরোটাই বিদেশি ঋণে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি অর্থবছরে আয় আরও কমে, ব্যয় বাড়তে পারে। রেলওয়ের হিসাবে, বছরে ৯ কোটি ২৭ লাখ যাত্রী ট্রেনে ভ্রমণ করে। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ ৫৩ হাজার যাত্রী ট্রেনে ভ্রমণ করে। এ যাত্রীর বড় অংশই বিনা টিকিটে যাতায়াত করে।

সূত্র মতে, গত অর্থবছরে (২০২১-২২) রেল আয় করেছে ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। ব্যয় করেছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০) আয় ১ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা, ব্যয় ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। বিগত দুই অর্থবছরে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা। আয় হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৫৩২ কোটি। যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন পরিচালনায় দুই বছরে গড়ে ৭০০ কোটি টাকা করে আয় হয়েছে। অর্থাৎ গত দুই অর্থবছরে শুধু রেল পরিচালনায় লোকসান গুনতে হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। বছরে লোকসান ২ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকার বেশি।

রেলওয়ের তথ্যমতে, পূর্বাঞ্চলের ২০০ ট্রেনের মধ্যে ৫৪টি বন্ধ। আর পশ্চিমাঞ্চলের ১৬৮টি ট্রেনের মধ্যে ৫১টি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। যাত্রীদের চাহিদা থাকার পরও নানা সংকটের অজুহাতে এসব ট্রেন বন্ধ রয়েছে। এসব ট্রেনের মধ্যে ৫০ বছর ধরে চলা পুরোনো ট্রেনও রয়েছে।

রেলওয়ের তথ্যমতে, সবকটি ট্রেন চালাতে প্রয়োজন ৩ হাজারের বেশি কোচ এবং প্রায় ৫০০ ইঞ্জিন। কিন্তু রেলে বর্তমানে সচল ইঞ্জিন আছে ২৬৪টি এবং কোচ আছে দেড় হাজারের বেশি। আবার এসব ইঞ্জিনের মধ্যে ৬৭ শতাংশ এবং ৪৭ শতাংশ কোচের আয়ুষ্কাল শেষ হলেও চলছে। গত এক দশকে ইন্দোনেশিয়া থেকে কেনা ৩৫০টি কোচের একটির সঙ্গে অন্যটির জোড়া লাগানোর পদ্ধতি আলাদা হওয়ায় একটি বিকল হয়ে গেলে অন্যটি ব্যবহার করা যায় না। সংকটের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কেনা ৩০টি ইঞ্জিনের সব রুটে চলাচলে উপযোগী নয়। এ ছাড়া ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চীন থেকে আনা ২০ সেট ডেমুর বেশিরভাগ অকেজো। শুধু কোচ ও ইঞ্জিন নয়, সংকট রয়েছে জনবলের। এ কারণে সারা দেশের মোট ৪৮৪টি স্টেশনের মধ্যে ১১৬টি বন্ধ রয়েছে। রেলের মোট ৫ হাজার ৮৪১টি দাপ্তরিক পদের মধ্যে মাত্র ২ হাজার ৩৯৫টি পদে জনবল রয়েছে। বাকি ৩ হাজার ৪৪৯টি পদ শূন্য।

রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, সংকটের কারণে লোকাল ট্রেনগুলো বন্ধ। জনবল সংকট প্রকট। স্টেশন মাস্টার, গার্ড, পয়েন্টম্যানের সংকট রয়েছে। নতুন লোকবল নিয়োগ হচ্ছিল না। আবার পুরোনো লোকজন অবসরে যাচ্ছেন। নতুন করে নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছি। জনবল সংকট কেটে যাবে আশা করি। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আস্তে আস্তে বন্ধ হওয়া ট্রেনগুলো চালু করা হবে বলেও জানান তিনি।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও জনগণ বঞ্চিত হলে দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে রেলওয়ে প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার) ঠিক করতে পারছে না। দূরপাল্লায় গুরুত্ব দিতে গিয়ে স্বল্প দূরত্বের ট্রেন বন্ধ রাখা দেশ বা রেলওয়ে কোনো দর্শনের সঙ্গেই মেলে না। এখন পুরো পৃথিবীতে ট্রেনসেবা বেঁচে আছে কমিউটার সার্ভিস (ছোট ছোট দূরত্বে ট্রিপ) দিয়ে। সকাল-বিকেল এই সার্ভিসের চাহিদা থাকে। লাভজনক প্রতিষ্ঠান হতে হলে রেলকে কৌশলী হতে হবে।

রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজান হোসেন বলেন, বন্ধ হওয়া ট্রেনগুলো পর্যায়ক্রমে চালু করা হবে। লোকমাস্টার ও কোচ সংকট সবচেয়ে বেশি। সবকিছু সমাধানের চেষ্টা চলছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সমাজসেবা অধিদপ্তরে ৩৪৮ জনের বিশাল নিয়োগ 

দেশকে রাহু মুক্ত করতেই বিএনপির আন্দোলন : গয়েশ্বর

মুক্তিযোদ্ধার ছদ্মাবরণে জিয়াউর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের চর : পররাষ্ট্রমন্ত্রী 

ফেনীতে পৃথক স্থানে সড়কে ঝড়ল ২ প্রাণ

রাতেই ৯ জেলায় ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে কোলে নিয়ে কাবা দেখালেন নিরাপত্তাকর্মী

রেকর্ড গড়তে ১৩ সেকেন্ডে এক লিটার লেবুর শরবত পান

অনিয়মের অভিযোগে বন্ধ ৮২ লাখ টাকার সড়ক

এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের জন্য দুম্বা আনছে জলদস্যুরা!

পরিসংখ্যান ব্যুরোতে ৭১৪ জনের পুনর্বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, থাকছে না বয়সের ছাড় 

১০

চট্টগ্রামে পোশাক কারখানায় আগুন

১১

বিডিজেএ'র সভাপতি মাসুম, সম্পাদক মাহবুব সৈকত

১২

অন্তর্বাস না পরায় নারীকে বিমান থেকে নামিয়ে দেওয়ার হুমকি

১৩

ত্বক ঝকঝকে রাখবে তরমুজ

১৪

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাজারে নেই কার্যত তদারকি

১৫

আঘাতের চিহ্ন পিঠে নিয়ে ভেসে এলো মৃত জোড়া কচ্ছপ

১৬

জাতীয় দিবসে হাসপাতালে আলোকসজ্জা না করায় শোকজ

১৭

১৫ হাজার টিকিটের জন্য ঘণ্টায় ২ কোটিবার চেষ্টা

১৮

চাচার ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ভাতিজা নিহত

১৯

১৫৯ জনবল নিয়োগ দেবে রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়

২০
*/ ?>
X