সকালে অফিসে বের হওয়ার সময় শফিকুজ্জামান তার স্ত্রী পপিকে বলেছিলেন, ফিরে এসে তাকে একটা কথা বলবেন। কী সে কথা, তা জানতে তখন থেকেই অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন পপি। তবে স্বামীর শেষ কথাটি জানা হলো না তার। রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় বিস্ফোরণে ভবনের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছেন শফিকুজ্জামান। সেইসঙ্গে চিরদিনের জন্য চাপা পড়ে গেছে তার না বলা কথা।
স্বামীর লাশ নিতে এসে ধানমন্ডি পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই আক্ষেপ করতে করতেই বিলাপ করছিলেন পপি জামান। এক ছেলে এক মেয়ের সংসার তাদের। তিনি বারবার বলছেন, মানুষটা সকালে বের হওয়ার সময় বলে গেলেন, এসে কথাটা বলবেন; কিন্তু আমি আর শুনতে পারলাম না।
গতকাল রোববার নিউমার্কেট এলাকায় সুকন্যা টাওয়ারের কাছে বিকট বিস্ফোরণে তিনতলা একটি ভবনের আংশিক ধসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে ওঠে আগুন। আধঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) বিস্ফোরণ থেকে আগুন লাগে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে তিনজনের, আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। নিহত তিনজনের লাশ রাখা হয় ধানমন্ডি পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।
জানা যায়, নিহত তিনজনই ওই ভবনের তৃতীয় তলায় লায়রা প্রোডাক্টসে কাজ করতেন। শফিকুজ্জামান ও তুষার কম্পিউটার অপারেটর ছিলেন। আব্দুল মান্নান ছিলেন অফিস সহকারী। শফিকুজ্জামানের বাড়ি রাজবাড়ী, থাকতেন সাভারে। আব্দুল মান্নানের বাড়ি গাজীপুর। তুষারের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে।
সরেজমিন হাসপাতালে দেখা যায়, নিহত আব্দুল মান্নানের (৬৫) দুই সন্তানের করুণ আর্তনাদে হাসপাতাল ভারি হয়ে উঠেছে। শফিকুজ্জামানের স্ত্রী ‘না বলা কথা’ শোনার আফসোসে কান্না করছেন। তুষারের পরিবার লম্বা জ্যাম ঠেলে যখন হাসপাতালে পৌঁছান, ততক্ষণে তারা শোকে পাথর।
বাবা আব্দুল মান্নান আহত হয়েছেন শুনে ছোট ভাই শাকিল ও মাকে নিয়ে এসেছেন আশিক। শাকিলের বাবা-বাবা চিৎকারে হাসপাতালে উপস্থিত মানুষের চোখের পানি ধরে রাখা দায় হয়ে পড়ে। তাদের মা শুধু বিড়বিড় করে বলছিলেন, আমার আর কিছু থাকল, না আমি সব হারালাম।
বড় ছেলে আশিক কালবেলাকে বলেন, বাবা সকাল ৮টায় বের হন। ঠিক সাড়ে ১০টার দিকে ফোন এলো ভবন ধসে পড়েছে। সবাই মিলে তাড়াহুড়া করে বের হলাম। ভাবলাম, হয়তো আঘাত পেয়ে থাকতে পারেন; কিন্তু হাসপাতালে এসে শুনি বাবা সেখানেই মারা গেছেন।
আশিক বলেন, ৩৩ দিন আগে তার ছোট বোন ১২ বছর বয়সে মারা গেছেন। আজ তার বাবা চলে গেলেন। তারা কীভাবে এই শোক সামাল দেবেন। আশিকের কথা বলার সময়ে তার মা ও ছোট ভাই চিৎকার করে কাঁদছিলেন।
তুষারের পরিবার এসেছেন নরসিংদী থেকে। মৃত্যুর খবর পেয়েই বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলা তার স্বজনরা কোনো শব্দ করছেন না। যতদ্রুত লাশ নিয়ে যাওয়া যায়, সেটিই দেখছেন তারা।
পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিকিৎসক অধ্যাপক এ এম এস এম সারাফুজ্জামান (রুবেল) সাংবাদিকদের বলেন, বিস্ফোরণে নিহত তিনজন মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। এ ছাড়া তাদের শরীরে দগ্ধ হওয়ার চিহ্ন রয়েছে। তবে পুরো শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কাচের টুকরো ঢুকে গেছে।