প্রেরণা হয়ে থাকবেন স্টিফেন হকিং

স্টিফেন হকিং।
স্টিফেন হকিং।ছবি : সংগৃহীত

পৃথিবীতে মানুষ কখনো থেমে থাকবে না, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সংকট ও সমস্যাকে মোকাবিলায় একমাত্র সহায় হচ্ছে বিজ্ঞানের সম্ভাবনাগুলো খতিয়ে দেখা। কেননা, একমাত্র বিজ্ঞান শিক্ষাই পারে সহনশীল, গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে, যা মানবজাতির সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের কথা বলে। এই স্রোতধারায় স্টিফেন হকিং নিজেকে প্রবাহিত করেছিলেন। হয়তো গুরুতর অসুস্থতা ও শারীরিক বিকলাঙ্গতার কারণেও তিনি প্রণোদিত হয়েছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষকে বিজ্ঞান ও মহাবিশ্বের ধারণাবলি থেকে দূরে না রেখে এগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তাহলেই মানুষ অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত হবে।

প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে অগ্রগতির পেছনে গ্যালিলিওর চেয়ে বেশি অবদান আর কেউ রাখতে পারেননি–এ কথা মনে করতেন হকিং। এই কারণে গ্যালিলিওর মৃত্যুদিনে (৮ জানুয়ারি, ১৬৪২) জন্মেছিলেন বলে তিনি গর্ববোধ করতেন। গ্যালিলিওর মৃত্যুর ঠিক তিনশ বছর পরে ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি স্টিফেন হকিং অক্সফোর্ডে জন্মেছিলেন। তার মৃত্যুদিনের (১৪ মার্চ) সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। দিনটি আপেক্ষিক তত্ত্বের জনক আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম। আগে জানলে এটি নিয়েও তিনি গর্ব করতেন। তিনি ছিলেন হকিং বিকিরণের জনক। আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে এক শাস্ত্রে পরিণত করার চেষ্টা তিনি করেছেন। এর মাধ্যমে মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন।

১৯৮৮ সালে টাইম পত্রিকায় স্টিফেন হকিংকে নিয়ে একটি প্রচ্ছদ হয়। সেখানে তাকে অভিহিত করা হয় মাস্টার অব দ্য ইউনিভার্স বলে। বিশ্বসৃষ্টি রহস্য উন্মোচনে মানব-

ইতিহাসের সবচেয়ে অগ্রসর অভিযাত্রী হিসেবে বিজ্ঞানী মহল মেনে নিয়েছে। কৃষ্ণবিবর ও মহাবিশ্ব গবেষণার মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানকে এক নতুন যৌক্তিক স্তরে নিয়ে গেছেন।

সমগ্র ইতিহাসে খোঁজ করলে আমরা সংখ্যায় খুবই স্বল্প হলেও এ ধরনের কিছু চরিত্রের খোঁজ মিলবে। হেলেন কিলার, নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি, আলেক্সান্দার কিবালচিচ। অতএব বলা যায়, হকিংই শেষ নয় বা প্রথমও নয়, হকিং শুধু আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মানুষ ভবিষ্যদ্বাণীর অযোগ্য এক প্রতিভাস। তার পক্ষে অনেক কিছুই সম্ভব। তবে এরকম একটি চরিত্রের উঠে আসার জন্য পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সামাজিক সহযোগিতার মনোভাব লাগে। আমার মনে হয়, এরকম সহযোগিতা পাওয়ার উপলব্ধি ও কৃতজ্ঞতাবোধ হকিংকে প্ররোচিত করেছিল। তিনি অনুভব করেছিলেন, মানুষকে বিজ্ঞান ও মহাবিশ্বের ধারণাবলি থেকে দূরে না রেখে এগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন। সত্যি তিনি তা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। এক, মহাবিশ্বের লয় বা সৃষ্টি ধর্মগ্রন্থের বিষয় থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলেন বিজ্ঞানের গবেষণায়। দুই, আইজ্যাক আসিমভ, আর্থার সি ক্লার্ক ও কার্ল সাগানের পথ ধরে বিজ্ঞানকে, বিশেষত মহাবিশ্ব বিষয়ক গবেষণা গণমানুষের চিন্তার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন। কেননা মহাবিশ্বে মানুষ নিজের অবস্থান বুঝতে পারলে পৃথিবীর প্রতি তার একটি স্বচ্ছ ধারণা জন্ম নেবে। তবেই পৃথিবীর অস্তিত্ব রক্ষার্থে মানুষ সচেতন হয়ে উঠবে। আর তা যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সঠিক পাঠ হিসেবে পড়ানো হয় তাহলে ‘মহাবিশ্ব ও নিজের মধ্যকার গভীর সম্পর্ক’ দৃষ্টিভঙ্গিতে মহাবৈশ্বিক চেতনার বিকাশ ঘটাবে।

১৯৮৮ সালের ব্রিফ হিস্টোরি অব টাইম বইটা লেখার পর তিনি পৃথিবীর মানুষের কাছে অপরিচিত থাকেননি। এই বইটি লিখে তিনি পৃথিবীর মানুষের হৃদয় জয় করেন। সাধারণ মানুষও মহাবিশ্ব, নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু, কৃষ্ণবিবর নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ হন। তার বই লেখার ধরন দেখেই বোঝা যায়, কৃষ্ণবিবরের এই গবেষক গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌলিক ভাবনাগুলোর সঙ্গে সাধারণের যোগাযোগ না ঘটলে সমাজ কখনোই সামনের দিকে এগোতে পারে না; স্থিতিশীলও হয় না। এই কারণে বিজ্ঞানকে ছাড়া প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার সভ্যতাকে রীতিমতো অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিয়েছে। কার্ল সাগান ও মার্টিন রিজের মতো বিজ্ঞানীরা গ্রহান্তরে ছড়িয়ে পড়াকে এই সংকট নিরসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় মনে করেছেন। হকিংও এই বিষয়ের সঙ্গে একমত পোষণ করে হেঁটেছেন।

তিনি লুকাশিয়ান প্রফেসরের পদ থেকে অবসর নেন ২০০৯ সালের অক্টোবরে। এই পদে শুধু নিউটন নন, প্রতিপদার্থ ধারণার প্রবর্তক পল ডিরাকও ছিলেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে মটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত হন হকিং। চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, বছর দুয়েকের বেশি আয়ু নেই তার। রোগে আক্রান্ত হওয়ার কিছুদিনের ভেতর হারিয়ে ফেলেন স্বাভাবিক যোগাযোগের ক্ষমতা। তারপরও তিনি টিকে ছিলেন অনেকদিন। ৪৫ বছর ধরেই স্বাভাবিক চলাফেরার ক্ষমতা ছিল না হকিংয়ের। কিন্তু অসাধারণ সব গবেষণা করেছেন। তারই ভিত্তিতে মানব সমাজে সংঘটিত ঘটনাবলি নিয়ে কথা বলতে দ্বিধা করেননি।

মহাবিশ্ব থেকে আরম্ভ করে জীবন-মৃত্যু সংক্রান্ত তার যে কোনো মন্তব্য পৃথিবীর সবচেয়ে সাধারণ মানুষটিও ভাবনার মধ্যে নিয়েছে। পত্রপত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে প্রকাশ পেয়েছে। তার প্রকাশিত মন্তব্য শুধু বিজ্ঞান নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমাজ, সভ্যতা, রাজনীতি এমনকি প্রেম নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। তিনি নিজের ভুলকেও অকপটে স্বীকার করেছেন এবং বারবার নিজেকে ভেঙেছেন আর নতুন ধারণার কথা বলেছেন প্রায় ৩০ বছর ধরে।

তিনি কোয়ান্টাম জগতের অনিশ্চয়তা নীতিকে তিনি নিয়ে গেছেন কৃষ্ণগহ্বরের কাছে। আশ্চর্য হয়ে দেখালেন কৃষ্ণগহ্বর অত কালো নয়! ওখান থেকে বের হয়ে আসছে কণাস্রোত! তার মানে, কণা বের হয়ে একসময় কৃষ্ণবিবরও নিঃশেষ হয়ে যাবে। ১৯৭৩ সালে হকিং কৃষ্ণবিবরের এই কণাস্রোতের কথা বলেন। আর তা ঘটছে কৃষ্ণবিবরের প্রভাবে কোনো বস্তুকণা বা আলোকে আটকে ফেলার শেষ সীমানা ঘটনার দিগন্ত থেকে। মহাকর্ষের প্রভাবে স্থানকালের শূন্যতায় সৃষ্টি হচ্ছে কণা-প্রতিকণা। একটি ঢুকে যাচ্ছে কৃষ্ণবিবরে। আর একটি সরে যাচ্ছে। দূরের দর্শকদের কাছে মনে হবে কৃষ্ণগহ্বর থেকে যেন কণাস্রোত বের আসছে। এর নামই হচ্ছে হকিং বিকিরণ!

পদার্থ বিজ্ঞানে হকিংয়ের দুটি অবদানের একটি হচ্ছে এটি। কখনো কখনো একে বেকেনস্টাইন-হকিং বিকিরণ নামে অভিহিত করা হয়। দ্বিতীয় অবদানটি হচ্ছে সতীর্থ রজার পেনরাজের সঙ্গে মিলে সাধারণ আপেক্ষিকতায় অনন্যতার তত্ত্ব। তিনি প্রথম জীবনে এই কাজটি করেছিলেন।

শারীরিকভাবে ভীষণ রকম অচল হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীকে শুধু পদার্থ বিজ্ঞানে নয়, সমগ্র চিন্তার ক্ষেত্রকে এগিয়ে দেওয়ার প্রণোদনা জুগিয়েছেন। তিনি মানব অস্তিত্ব রক্ষায় বারবার সতর্ক করেছেন। কয়েক বছর আগে ইসরায়েলি বাহিনী গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি শিশু ও নারীদের নির্বিচারে হত্যা করলে হকিংই প্রথম বিজ্ঞানী, যিনি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। উল্লেখ্য সেই সময় বিনা উস্কানিতে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী ৯ দিন ধরে গাজা শহরে মানবতাবিবর্জিত হামলা চালায়। এই পদার্থবিজ্ঞানী শুধু নিন্দাই জানালেন না, ইসরায়েলের জেরুজালেম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। স্টিফেন হকিংয়ের এ সিদ্ধান্ত ইসরায়েলের জন্যে এক বড় ধরনের আঘাত ছিল বলে গার্ডিয়ান পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছিল। কেননা, হকিংয়ের পথ ধরে আরও অনেক বিজ্ঞানী এই কনফারেন্সে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এমনকি অনেক সংগীতশিল্পী, চিত্রকর ও লেখকও কনফারেন্সে যোগ দেননি।

প্রায়ই এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। তা হলো হকিং কি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বা তার পাওয়া উচিত ছিল? উত্তরে বলা যায়, যে কোনো তত্ত্ব যত সুন্দর হোক, তার ফলগুলো পরীক্ষিত না হলে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় না। আর সবকিছুকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে মাপা উচিত নয়। আমার মনে হয় স্টিফেন হকিংকে ঘিরে মানবজাতি, পৃথিবীর অস্তিত্ব ইত্যাদি ব্যাপার আছে। তার দর্শনও মানুষকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছিল। তিনি আসলে দেশ ও জাতির ঊর্ধ্বে উঠে মানবজাতির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

আজ হকিংয়ের প্রয়াণ দিবস। তার প্রতি রইল গভীর কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা।

লেখক: বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com