আসিফ পিনন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:৫৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বুয়া-আয়া-ধাত্রী চালান নিরাপদ প্রসব সেন্টার

বুয়া-আয়া-ধাত্রী চালান নিরাপদ প্রসব সেন্টার

স্বামী ছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী, স্ত্রী ধাত্রী। এই দম্পতি চট্টগ্রামের বাকলিয়া বউবাজারে খুলেছেন ‘নিরাপদ প্রসব সেন্টার’। এখানে প্রসূতির ‘স্বাভাবিক প্রসব’ করান তারা। এই কাজে যুক্ত থাকেন অপ্রশিক্ষিত আয়া, ধাত্রী থেকে শুরু করে ঝাড়ুদার পর্যন্ত। সম্প্রতি সেখানে এক প্রসূতির মৃত্যুর অভিযোগ তুলেছেন স্বজনরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গড়ে উঠেছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে সেবাগ্রহীতাকে ডেকে আনছে। পরে নানান ভয়ভীতি দেখিয়ে শিকারে পরিণত করছে তারা। সমাজের হতদরিদ্র একটি গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত এসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিপদে পড়ছে, থাকছে মৃত্যুঝুঁকিও।

গত ১৩ জানুয়ারি রাতে নরমাল ডেলিভারি করাতে এ প্রসব সেন্টারে ভর্তি করা হয় জান্নাতুল ফেরদৌস নিহাকে। সেখানে অপচিকিৎসায় মৃত্যু হয় তার। নিহার মা নাজমা বেগম কালবেলাকে বলেন, ‘সেদিন দুপুরে ফেসবুক পেজে তারা খবর পান, সেখানে নরমাল ডেলিভারি করানো হয়। বিকেলে চেকআপ করাতে যান মা-মেয়ে। কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটির এমডি ফাহিমা শাহাদাত তাদের বলেন, গর্ভের বাচ্চা নিচের দিকের নেমে গেছে, জরায়ুর মুখ খুলে গেছে। শরীরের পানি শুকিয়ে জন্ডিসের ভাব এসে গেছে। যদি এখনই ডেলিভারি করানো না হয় মা-বাচ্চা বাঁচবে না।’

নাজমা বেগম বলেন, ‘আমার মেয়ের ডেলিভারি ডেট ছিল ২৫ জানুয়ারি; কিন্তু তার (ফাহিমা শাহাদাত) কথা শুনে আমার কলিজা ধরে যায়, আমি ভর্তি করিয়ে দিই। এ সময় তারা সাদা কাগজে আমাদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেন। সেদিন বিকেলে ভর্তি করা হলেও রাতে অনেক স্যালাইন দিয়ে মেয়ের প্রসব বেদনা তোলা হয়। নিহাকে একটি রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর রাত ৩টার দিকে বাচ্চার ডেলিভারি করানো হয়। ১৫ মিনিট পর তারা বলে মেয়ে আর বাচ্চার অবস্থা ভালো না, রক্ত লাগবে। বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যান। আমাদের অবস্থা খারাপ দেখে ভেতর থেকে একটি ছেলে এগিয়ে এসে অটোরিকশা এনে দেয়। কয়েকজন ধরাধরি করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে মেয়ে মারা যায়, দুদিন পর বাচ্চাটিও মারা যায়।’

নাজমার প্রতিবেশী নাসিমা বেগম বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে শুনে আমি গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি তিন রুমের একটি বাসায় দুটি বেড। যখন নিহা চিৎকার করছে, তখন চিৎকারের শব্দ বাইরে যেন শুনতে পাওয়া না যায় তার জন্য ঠান্ডার মধ্যে ফ্যান ছেড়ে দেয় তারা। সাউন্ড বড় করে টিভি চালিয়ে দেওয়া হয়।’

নাছিমা ও নাজমা বেগম থাকেন চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার এলাকার ইদ্রিস কলোনির ভাড়া বাসায়। হতদরিদ্র এ পরিবারের বড় মেয়ে নিহা। ২০১৮ সালে নিহার সঙ্গে সিলেটের বাসিন্দা মো. আল আমিনের বিয়ে হয়। আল আমিন আর নিহার পরিবারে আড়াই বছরের একটি কন্যাসন্তান আছে।

নিহার স্বামী আল আমিন বলেন, ‘ফেসবুক গ্রুপে নরমাল ডেলিভারির খবর পেয়ে নিহা আমাকে ফোন করে ১ হাজার টাকা বিকাশ পাঠাতে বলেছিল। জানিয়েছিল চেকআপ করাবে। সেখানে সেন্টারের লোকজন জোর করে ভর্তি করিয়ে তাদের মেরে ফেলল। বাচ্চাটা দুদিন চমেক হাসপাতালে ভর্তি ছিল। মারা যাওয়ার পর চিকিৎসকরা জানিয়েছেন বাচ্চার মেরুদণ্ডে আঘাত ছিল। চট্টগ্রামে নিহার উপযুক্ত পুরুষ অভিভাবক না থাকায় আইনি ব্যবস্থা নিতে পারিনি, ওখানে আমারও কেউ নেই।’

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফাহিমা শাহাদাত। তার ভিজিটিং কার্ডে পরিচয় লেখা হয়েছে, তিনি স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিষয়ক অভিজ্ঞ, আছে পরিবার পরিকল্পনার ট্রেনিং এবং সেফ ডেলিভারি ট্রেনিং। বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল থেকে ধাত্রীবিদ্যা প্রশিক্ষণও আছে বলে প্রচার রয়েছে তাদের ফেসবুক পেজে।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে সরাসরি যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেন্টারটির ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন মধ্যবয়সী এক লোক। তবে সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তার পরিচয় জানাতে অসম্মতি জানান তিনি। পরে এমডি ফাহিমার ফোনে যোগযোগ করা হলে তিনি লাইন কেটে দেন। সর্বশেষ শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ডা. ফাহিমা ম্যাডাম ব্যস্ত আছেন। আমি রিসিপশনের দায়িত্বে আছি। কিছু তথ্য জানার থাকলে আমাকে বলেন।’ এরপর একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য জানা যায়নি।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী বলেন, ‘একটি ফ্ল্যাট বাসায় অনুমোদিত কোনো ডেলিভারি সেন্টার আছে কিনা, সেটি আমার জানা নেই। তা ছাড়া আমরা অনুমতি দিই না, মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। আমরা শুধু তদারকি করি। যে প্রতিষ্ঠানটির কথা বলছেন তাদের ঠিকানা দেন, ব্যবস্থা নেব।’

ভুয়া চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে প্রাণহানির দায় চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন অফিস এড়াতে পারে না বলে মনে করছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোাসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। ভুয়া ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিকের পর এবার নতুন নাম শুনলাম ডেলিভারি সেন্টার। এসব প্রতিষ্ঠান বরাবরই ঘিঞ্জি এলাকার হতদরিদ্র-গরিব লোকজন টার্গেট করে কার্যক্রম চালায়। কম টাকায় চিকিৎসা পাওয়ার আশায় অনেকে প্রাণও হারাচ্ছেন। আমরা বারবার জানিয়েছি সিভিল সার্জন অফিস যেন এসব তদারকি করে; কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে তারা দায় এড়িয়ে চলেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

চট্টগ্রামের বাকলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ভুয়া চিকিৎসা কেন্দ্র থাকার কথা এবারই নতুন নয়। এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকরাও। তারা বলছেন, এসব প্রতিষ্ঠান দ্রুত বন্ধ করা না গেলে বিপদ আরও বাড়বে। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ন ম মিনহাজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি প্রচারের নামে প্রতারণা করে আসছে। আইনগতভাবে এ রকম ডেলিভারি সেন্টার খোলার নিয়ম নেই। যারা খুলেছেন তাদের কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে।’

সরেজমিনে দেখা যায়, বউবাজার সুবর্ণ আবাসিক এলাকার ইলিয়াস বিল্ডিংয়ের সামনে ঝুলানো হয়েছে মাঝারি আকৃতির একটি সাইনবোর্ড। লেখা আছে, ‘নিরাপদ প্রসব সেন্টার।’ এখানে অল্প খরচে আধুনিক চিকিৎসাসেবায় গর্ভবতীদের চেকআপ ও নরমাল ডেলিভারি করানো হয়।’ আবাসিক ভবনের নিচতলার বাম পাশে একটি ফ্ল্যাটে গড়ে তোলা হয়েছে তথাকথিত নিরাপদ প্রসব সেন্টারটি।

একজন প্রহরীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি ফ্ল্যাটের ভেতরে আছে তিনটি করে রুম। একটি ছোট রান্নাঘর, সংযুক্ত টয়লেট। নিচতলার প্রসব সেন্টারে বিকেলের দিকে কিছু রোগী আসে। তাদের বাইরে বসতে দেওয়া হয়। প্রসব সেন্টারের ভেতরে দেখা গেছে, সাদা পর্দা আর চাদরে গড়ে তোলা হয়েছে হাসপাতালের আবহ। থার্মোমিটার, স্কেল, কলম, ডায়েরিসহ কিছু জিনিসপত্র দেখা গেছে।

আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা জানান, শুধু ওই সেন্টার নয়। বাকলিয়া মিয়াখান নগর, পুলিশ বিট, বউবাজার, বগারবিল, খাজা হোটেল-সংলগ্ন বেশ কিছু ফার্মেসি দোকান ও ভাড়া বাসায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। চিকিৎসক কিংবা সেবার ছিটেফোঁটা না থাকলেও এমন কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে নামসর্বস্ব এনজিও সংস্থার নামে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নাটোরে ইস্তিস্কার নামাজ আদায়

শ্রমিক সংকটে বোরো চাষিরা

২৮৮ সেনা-বিজিপি সদস্যদের মিয়ানমারে হস্তান্তর

পোস্ট অফিসে আইসক্রিমের ব্যবসা

৪০ দিন আগেও প্রস্তুত নয় বিশ্বকাপের ভেন্যু

ইউক্রেনকে গোপনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

ইসরায়েলি ড্রোন ভূপাতিত করে কঠিন বার্তা হিজবুল্লাহর

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

বোরো আবাদে হিটশকের শঙ্কা

এসির ‘টন’ মানে কী?

১০

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১১

প্রতীক বরাদ্দের আগেই পোস্টার বানিয়ে প্রচারে আ.লীগ নেতা

১২

২৫ এপ্রিল : নামাজের সময়সূচি

১৩

সাতক্ষীরায় ৬০ বছর পর ৩৩ বিঘা সরকারি জমি উদ্ধার

১৪

দাবদাহে ঝরছে লিচুর মুকুল, দুশ্চিন্তায় দিনাজপুরে চাষিরা

১৫

তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে কুমিল্লায় গাছ লাগাচ্ছে ছাত্রলীগ

১৬

ফরিদপুরের ঘটনা আদিম যুগের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে : আব্দুর রহমান

১৭

২৪ ঘণ্টায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ২ কর্মী খুন

১৮

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে বিপদে জর্ডান

১৯

‘হারল্যান স্টোর’ মিরপুর-১০ শাখার উদ্বোধন করলেন নুসরাত ফারিয়া

২০
*/ ?>
X