
সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে বিদেশি শিক্ষার্থীদের কোটায় ভর্তি বাণিজ্য করতেন এস এম আনিস। হোস্টেলে সিট পাইয়ে দেওয়া এবং পুলিশে কনস্টেবল নিয়োগসহ নানা সরকারি নিয়োগে জালিয়াতি করতেন তিনি। তার এসব অপকর্মে ছায়া হিসেবে কাজ করতেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সদ্য সাবেক অতিরিক্ত সচিব নিতিশ চন্দ্র সরকার। প্রতারক আনিসের হয়ে তিনি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষদের ফোন দিতেন। তার ফোন পেয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য সংরক্ষিত আসনে ভর্তি হতো দেশি শিক্ষার্থীরা। এভাবে পার্সেন্টেজ নিতেন সাবেক ওই সরকারি কর্মকর্তা।
প্রতারক আনিসকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এসব তথ্য পেয়েছে। গত শুক্রবার ডিবির লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালি জোনাল টিম তাকে গ্রেপ্তার করে। গতকাল শনিবার ডিবি তাকে আদালতে হাজির করে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। ওই ঘটনায় দায়ের মামলায় ৩ নম্বর আসামি সাবেক অতিরিক্ত সচিব নিতিশ চন্দ্র সরকার। মামলায় তাকেসহ মোফাজ্জল করিম জাহিদ এবং আরও চারজনকে পলাতক দেখানো হয়েছে।
ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, সাবেক ওই কর্মকর্তার সহায়তায় আনিস শতাধিক শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করেছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা জানতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
গ্রেপ্তার আনিসের দেওয়া তথ্যের উদ্ধৃত করে ডিবির তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবেক ওই সরকারি কর্মকর্তা একজন শিক্ষার্থী ভর্তি বাবদ ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা পার্সেন্টেজ নিতেন। জব্দ করা কাগজপত্রে দেখা গেছে, সর্বশেষ এক শিক্ষার্থীকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করাতে তিনি আনিসের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া হোস্টেল পেতে তদবিরের জন্য তিনি ডলার হিসাব করে টাকা নিতেন।
ডিবির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারক আনিসের ওস্তাদ মোফাজ্জল করিম জাহিদ। প্রতারণার টাকায় সে বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন। এই দুজনের অপকর্ম ও জালিয়াতির নেপথ্যে ছিলেন সদ্য সাবেক সরকারি কর্মকর্তা নিতিশ চন্দ্র। তিনি বর্তমানে অবসরকালীন ছুটিতে রয়েছেন।
ডিবির লালবাগ বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, আনিস-জাহিদ চক্রের টার্গেট থাকত মূলত বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এসব স্বাস্থ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য সংরক্ষিত আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী পাওয়া না গেলে সেই সুযোগটা কাজে লাগাত চক্রটি। তারা ফাঁকা আসনে দেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাত। এ ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তের সন্তানরা টার্গেটে থাকতেন। এই ভর্তির জন্য আনিস বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানের প্যাডে লিখিত পাঠাত সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের কাছে। এরপর সরকারি কর্মকর্তা নিতিশ চন্দ্র সংশ্লিষ্ট অধ্যক্ষকে ফোন করে ভর্তি নিতে বলতেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ কালবেলাকে বলেন, আনিসের নেতৃত্বাধীন চক্রের নেপথ্যে সদ্য অবসরে যাওয়া একজন সরকারি কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পেয়েছেন তারা। আরও কিছু নাম পাওয়া গেছে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে।
ডিবির লালবাগ বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, আনিস সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ‘ফ্রেন্ডস অ্যাডমিশন কনসালটেন্ট’ নামে প্রতিষ্ঠান খুলে প্রতারণা করে আসছিল। যদিও ওই ট্রেড লাইসেন্সটি সে স্ট্যাম্পমূলে অন্য এক প্রতারক জাহিদের কাছ থেকে নিয়েছে। পুরো ঘটনার তদন্ত চলছে।
বুক ফুলিয়ে সচিবালয়ে ঘুরতেন ম্যাট্রিক পাস আনিস : তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আনিস টেনেটুনে ম্যাট্রিক পাস করেছে। সেই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েই চলতেন বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে। পরিচয় দিতেন কনসালটেন্সি ফার্মের পরিচালক। ওই পরিচয়ে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ঘুরে বেড়াতেন। গত কয়েক মাসে অন্তত ৩০ বার সে সচিবালয়ে গিয়েছে। তাকে সচিবালয়ে প্রবেশে গেট পাসের ব্যবস্থা করে দিতেন তখনকার স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নিতিশ চন্দ্র সরকার।
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে আনিস জানিয়েছে, তারা ভর্তি পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য ১৫ থেকে ২০ লাখ করে টাকা নিত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। সিট পাইয়ে দিতে নেওয়া হতো দেড় থেকে ২ লাখ টাকা। হোস্টেলে সিট পাইয়ে দিতে ভারত, নেপাল, ভুটানসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে আসা বিদেশি শিক্ষার্থীর কাছে ৪ থেকে ৫ হাজার ডলার নেওয়া হতো। এসব থেকে নির্দিষ্ট অংশের টাকা দেওয়া হতো নিতিশ চন্দ্র সরকারকে।
সুযোগ নিতেন মেডিকেলের অসাধু কর্মকর্তারাও : তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রয়েছে প্রায় ২০ ভাগ; কিন্তু দেশের বেশকিছু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫০ ভাগের বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী দেখানো হয়। মূলত এসব আসনে দেশি শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। উচ্চবিত্তের যেসব সন্তান সরকারি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পান না এবং মেধা তালিকা শেষের দিকে থাকেন, তাদের প্রায় কোটি টাকা নিয়ে ভর্তি করা হয়। এসব টাকা থেকে সাবেক অতিরিক্ত সচিব, আনিস চক্র এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও ভাগ পান। পুরো ঘটনারই তদন্ত শুরু হয়েছে।
যা বলছেন অভিযুক্ত কর্মকর্তা নিতিশ চন্দ্র : নিতিশ চন্দ্র সরকার গতকাল কালবেলাকে বলেন, তিনি আনিসকে চেনেন। তিনি একসময়ে গোপালগঞ্জের ইউএনও ছিলেন। আনিসের বাড়ি সেই এলাকায় হওয়ায় পরিচিত সে। সে পরিচয়ের সূত্র ধরে তাকে সচিবালয়ে ঢুকতে তিনি পাসের ব্যবস্থা করেছিলেন।
তিনি দাবি করেন, আনিস বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির বৈধ এজেন্ট। তিনি যেহেতু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ছিলেন, সে সুবাদে আনিসের অনুরোধে দু-একটি মেডিকেল কলেজে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য ফোনে অধ্যক্ষদের বলেছিলেন; কিন্তু ভর্তি হয়েছে বলে তার জানা নেই। এ ছাড়া ভর্তি থেকে টাকা নেওয়ার তথ্য মিথ্যা ও বানোয়াট। এটি সঠিক নয়।