শিক্ষক রাজনীতিতে ধুঁকছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষক রাজনীতিতে ধুঁকছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি : সংগৃহীত

উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেতে কিংবা নিজের পদ ঠিক রাখতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্রমেই জড়াচ্ছেন রাজনীতিতে। এমনকি ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের রাজনীতিতে সহযোগীর ভূমিকাও পালন করছেন অনেকে। অনেক সময় শিক্ষক পরিচয় উপেক্ষা করে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা চাউর করে জড়াচ্ছেন কোন্দলে, করছেন বিষোদ্গার। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তেমনি নষ্ট হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ। এমন অভিযোগ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকরাই।

চবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে দাবি-দাওয়া, শিক্ষক নিয়োগ, অর্থ লেনদেন নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দরকার। জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে পারলে এই বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচবে।’

উপাচার্য-ডিন দ্বন্দ্ব: গত বছরের ৪ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত এক সভায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারকে সমাবর্তনের আগে সিন্ডিকেটের ডিন ক্যাটাগরির নির্বাচন দেওয়ার অনুরোধ জানান ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী। এতেই বদলে যায় সভার পরিবেশ। তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে আসন ছেড়ে উঠে ক্ষুব্ধ উপাচার্য শাসাতে শুরু করেন অধ্যাপক নিজামীকে।

পরে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তখন উপাচার্যের সমালোচনা করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ায় অধ্যাপক মো. হেলাল উদ্দিন নিজামীর কাছে বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে চিঠি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০ নভেম্বর বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া অন্তত ৪৫টি বিতর্কিত ইস্যু টেনে ১৭ পৃষ্ঠার একটি লিখিত ব্যাখ্যা দেন অধ্যাপক নিজামী। যার ফলে বিভিন্ন অনিয়মের বিষয় ফের আলোচনায় আসে।

চিঠির এক পর্যায়ে অধ্যাপক নিজামী উল্লেখ করেন, উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের তিন বছরের মধ্যে তিনি (উপাচার্য) সিনেটে রেজিস্ট্রার গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন, শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন ও সিন্ডিকেটে ডিন প্রতিনিধি নির্বাচন দিতে পারেননি।

ডান-বাম-সাদা-হলুদ: ১৯৮৬ সাল থেকে চবির বিভিন্ন পর্ষদে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে আওয়ামী-বামপন্থি শিক্ষকদের হলুদ দল ও বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষক সমর্থিত সাদা দলের মধ্যে মূল দ্বন্দ্বের শুরু।

২০১৪ সালের সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন বয়কট করে জামায়াত-বিএনপিপন্থি সাদা দল। ২০২০ সালের ডিন নির্বাচন ও গত ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট নির্বাচন ছাড়া এখন পর্যন্ত অন্য কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়নি দলটি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চবি শিক্ষকদের মধ্যে যে দ্বন্দ্বটা শুরু হয়েছে, এর মধ্যে আদর্শের স্থান নেই। এটা ব্যক্তি স্বার্থেই হচ্ছে। আদর্শগত কারণে দলের ভিন্নতা থাকলেও সবার সহাবস্থান চাইত সবাই; কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তা হচ্ছে না।

জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল আমীন বলেন, ‘এখানে যত শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে, বেশিরভাগই রাজনৈতিক বিবেচনায়। মেধাকে বাদ দিয়ে রাজনীতিকে প্রাধান্য দেওয়ায় শিক্ষাব্যবস্থাটাই কলুষিত হচ্ছে।’

হলুদ দলে কোন্দল: দীর্ঘ চার বছর নির্বাচন না দেওয়ায় চবির আওয়ামী ও বামপন্থি হলুদ দলের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ ‘স্ট্যান্ডিং কমিটি' নিয়ে উঠেছে বিতর্ক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হলুদ দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির মধ্যেই উপাচার্যের পক্ষে-বিপক্ষে দুটি দল হয়েছে। যে কারণে বারবার স্ট্যান্ডিং কমিটি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে।

জানা যায়, হলুদ দলের যে কোনো নির্বাচনে মনোনয়ন নির্ধারণ করে স্ট্যান্ডিং কমিটি। আবার বর্তমান কমিটির অধিকাংশ সদস্য উপাচার্যবিরোধী। এ কারণে বিভিন্ন নির্বাচনে উপাচার্যপন্থি কোনো শিক্ষক মনোনয়ন পান না বলে অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষক সমিতি ও সিন্ডিকেটসহ বিগত নির্বাচনগুলোতে স্ট্যান্ডিং কমিটির মনোনয়নকৃত প্রতিটি পদের বিপরীতে উপাচার্যপন্থি শিক্ষকদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাখা হয়। এতেই দুপক্ষের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে।

গত ১১ নভেম্বর ওই স্ট্যান্ডিং কমিটির নতুন নির্বাচন চেয়ে আহ্বায়ক বরাবর চিঠি দেন উপাচার্যপন্থি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১ জন শিক্ষক। চিঠির পাল্টা জবাব দেয় স্ট্যান্ডিং কমিটি। জবাবে দলটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সেকান্দর চৌধুরী স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়—ওই ২০১ শিক্ষকের মূল উদ্দেশ্য নির্বাচন নয়, বিশেষ স্বার্থ সিদ্ধি।

শিক্ষক সমিতিতে দ্বন্দ্ব: গত বছরের ডিসেম্বরে চবি শিক্ষক সমিতির নেতাদের মধ্যে চলে আসা আন্তঃকোন্দল ব্যাপক আকারে দেখা দেয়। গত ৪ জানুয়ারি তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি (বর্তমান সাধারণ সম্পাদক) অধ্যাপক আব্দুল হক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. সজিব কুমার ঘোষকে ছাড়াই কার্যনির্বাহী পরিষদের সাধারণ সভা ডাকেন বলে অভিযোগ ওঠে।

এরই মধ্যে শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন, সিন্ডিকেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে গড়িমসিসহ চবি প্রশাসনের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ১৪ জানুয়ারি আন্দোলনের ডাক দেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক আবদুল হক। এর দুই ঘণ্টা পর সভাপতির ডাকা আন্দোলনকে বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা দাবি করে পাল্টা বিজ্ঞপ্তি দেন ড. সজীব কুমার ঘোষ।

১৬ জানুয়ারি শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে ফের মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেন অধ্যাপক আব্দুল হক। এতে অধ্যাপক আব্দুল হক (উপাচার্য ড. শিরীণ আখতারের সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই যার) ও উপাচার্যের আস্থাভাজন সমিতির অধ্যাপক ড. সজীব কুমার ঘোষের মধ্যে চরম মতবিরোধ দেখা দেয়।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে হলুদ দলের মনোনয়ন না পেয়ে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে ১১টি পদের প্রতিটিতেই প্রার্থিতা দেন উপাচার্যপন্থি শিক্ষকরা। ১১টি পদের ৭টিতেই নিরঙ্কুশ জয় পান হলুদ দলের মনোনীতরা। বিপরীতে ৪টি পদে জয় পান উপাচার্যপন্থিরা।

উপাচার্য-প্রক্টর দ্বন্দ্ব: এত দ্বন্দ্বের মাঝেও দীর্ঘদিন এক টেবিলে বসে বিশ্ববিদ্যালয়টাকে সামলে রেখেছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. রবিউল হাসান ভূইঁয়া। কিন্তু দাবি-দাওয়া, নিয়োগ ও লেনদেনের দ্বন্দ্ব ওই সম্পর্কে ধরায় ফাটল। প্রক্টর তার ২২ সহযোগীকে নিয়ে করেন পদত্যাগ। পদত্যাগের আধঘণ্টার মধ্যেই নতুন প্রক্টর নিয়োগ দেন উপাচার্য। এতেই প্রকাশ্যে আসে এক বছর ধরে চলা উপাচার্য-প্রক্টর দ্বন্দ্বের বিষয়টি।

ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে ম্যাডামের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বারবার আশ্বাস দিয়েছেন। পরে আবার সরে গেছেন। কিন্তু শিক্ষকরা আমাদের ভুল বুঝতে শুরু করেন। শেষে যখন দেখলাম, কোনো দোষ না করেও আমাদের অবস্থান বিতর্কিত হচ্ছে, তখন দায়িত্ব থেকে সরে গেছি।’

উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, ‘শিক্ষকদের কোনো দাবি নিয়ে তারা আসেননি। কিছু নিয়োগ এজেন্ডা ছিল, একে ওকে প্রোভাইড করবে; এসব তদবির নিয়েই তারা আসতেন। সেসব বাস্তবায়ন করতে না পেরে আমাকে বিব্রত করার চেষ্টা করছেন।’

এ প্রসঙ্গে শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি আইন বিভাগের অধ্যাপক জাকির হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান এ দ্বন্দ্বে আদর্শের স্থান নেই। এটা ব্যক্তি স্বার্থে হচ্ছে। উপাচার্যের পক্ষে যারা আছেন, দেখা যায় তারা উপাচার্যের ক্ষমতা, আর্থিক লেনদেন, নিয়োগ কেলেঙ্কারি, পদবি-কেন্দ্রিক লোভে পড়েই উপাচার্যের পক্ষ নেন।’

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু তাহের কালবেলাকে বলেন, ‘শিক্ষকরা দুর্নীতি করবে আর সেটার সমালোচনা শিক্ষার্থীরা করবে, আমাদের সময় এমনটা কল্পনাও করা যেত না। এসব ঘটনা শিক্ষার্থীদের মাঝে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। আশা করব, শিক্ষকরা এ সংকট দ্রুত কাটিয়ে উঠবেন।’

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com