জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের রেডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (ওএসডি) ডা. ফাতেমা দোজা ২০১২ সালে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন। এরপর আইন ভঙ্গ করে ফেরেন পুরোনো কর্মস্থলে। এক দশক ধরে নেন সরকারি বেতন-ভাতা। বাগিয়ে নেন পদোন্নতিও। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। অধ্যাপক পদোন্নতি নিতে গিয়ে আলোচনায় আসে তার জালিয়াতির তথ্য। নড়েচড়ে বসে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু বারবার শুনানির জন্য ডাকা হলেও অদৃশ্য ক্ষমতাবলে সাড়া দেন না এই চিকিৎসক। অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের শীর্ষ এক কর্মকর্তার স্ত্রী হওয়ায় একের পর এক অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন তিনি।
গত বছরের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে অনুষ্ঠেয় উত্তর আমেরিকার রেডিওলজিক্যাল সোসাইটি আয়োজিত ১০৮তম আন্তর্জাতিক বার্ষিক বৈজ্ঞানিক সেমিনারের আমন্ত্রণপত্রের শর্ত পরিবর্তনেরও অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তদন্তে সত্যতাও পায় মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে একাধিকবার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি। গত ১৯ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অভিযোগের বিষয়ে তাকে আবারও তিন দিনের মধ্যে জবাব দিতে চিঠি পাঠায়। কিন্তু এবারও জবাব দেননি। অভিযোগ রয়েছে, তাকে বাঁচাতে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর বেশ তৎপর। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই চিকিৎসকের বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রথমে তথ্য দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করে। দীর্ঘদিন চিঠি চালাচালির পর গত ১৫ ফেব্রুয়ারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডা. ফাতেমা দোজার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে তথ্য পাঠায়।
ডা. দোজার সহকর্মীরা বলেন, তিনি স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামালের স্ত্রী। আবার ডা. ফাতেমা দোজা, তার স্বামী অধ্যাপক আবুল বাশার মো. জামাল এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। সেই সুবাধে তিনি একের পর এক অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। যদিও অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. টিটো মিয়া বলেন, আমাদের অধিদপ্তরের সঙ্গে এই তদন্তের সম্পৃক্ততা নেই। আমি ওই অফিসের (হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের) কাউকে চিনিও না। এগুলো যারা বলে, তারা হয়তো তাদের সুবিধার্থে বলে।
সরকারি তথ্য বলছে, ডা. ফাতেমা দোজা ২০০৭ সালে রেডিওলজিস্ট পদে হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে যোগ দেন। এরপর ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে ছয় মাসের জন্য নিয়োগ পান। ওই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের তৎকালীন পরিচালকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সচিব বরাবর লিখিত আবেদন করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বরাবর তার অব্যাহতির আবেদন পাঠানো হয়। অতঃপর তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) আইন ১৯৯৮ (১নং আইন)-এর ১৪(১০) ধারা অনুযায়ী সম্পূর্ণ অস্থায়ীভাবে যোগদান করেন। এদিকে নির্ধারিত মেয়াদের পরও বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ তার চাকরি স্থায়ী করেনি। ওই সময় তিনি বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালেও প্র্যাকটিস করেন। চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার দেড় বছর পর অব্যাহতির বিষয়টি গোপন করে অসাধু উপায়ে হৃদরোগ হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত দেখিয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে ওই হাসপাতালে ২০১৩ সালের ১১ জুন যোগদান করেন। সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি নিয়ে একই হাসপাতালে ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট যোগ দেন। ২০২১ সালের ২ আগস্ট অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডে ৩৪ জনের নামের তালিকা পাঠানো হয়। ওই তালিকায় ডা. ফাতেমার নাম ছিল ১৪ নম্বর ক্রমিকে।
২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনের ৪৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারী অবসর গ্রহণের পর ৫১ ধারার বিধান অনুসরণ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্ম বা রাষ্ট্রের অন্য কোনো কর্তৃপক্ষে কোনো উপায়ে পুনরায় নিয়োগ করা যাবে না। তার এসব জালিয়াতির অভিযোগ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নজরে এলে ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্ম সচিব (প্রকল্প বাস্তবায়ন-১ শাখা) মিনা মাসুদ উজ্জামানকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। ১৫ কর্মদিবসের মধ্য প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে ডা. ফাতেমাদোজা সরকারি চাকরি আইন লঙ্ঘন করেছেন, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এজন্য তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হওয়া দরকার। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেটা হচ্ছে না। অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিষয়ে কথা বলতে নারাজ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন। তিনি কালবেলাকে বলেন, তদন্তাধীন একটি বিষয়ে আমি কিছুই বলব না। আপনারা মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নেন। তারাই আপনাকে এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অধিশাখার যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হেলাল হোসেন কালবেলাকে বলেন, ডা. ফাতেমা দোজার বিষয়ে তদন্ত চলছে। গত ১৯ মার্চ তাকে আরও একটি কারণ দর্শানোর বিষয়ে একটি নোটিশ পাঠানো হলেও তিনি জবাব দেননি। অভিযোগের বিষয়ে ডা. ফাতেমা দোজার সঙ্গে কথা বলার জন্য তার কর্মস্থলে গিয়ে পাওয়া যায়নি। ব্যক্তিগত ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।