আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৩, ১০:১১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিশুদের আনন্দ বনে গেল বিষাদ

শিশুদের আনন্দ বনে গেল বিষাদ

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের প্রত্যাশা আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড মডেল স্কুল থেকে ছয় শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল এবারের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায়। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত ফলে (ভুলের কারণে স্থগিত) দেখা যায় বিদ্যালয়টি থেকে চারজন বৃত্তি পেয়েছে। এর মধ্যে একজন ট্যালেন্টপুলে (মেধাবৃত্তি) ও তিনজন সাধারণ গ্রেডে। বিদ্যালয়প্রধান তার প্রতিষ্ঠান থেকে আরও বেশি মেধাবৃত্তি কামনা করেছিলেন; কিন্তু বুধবার রাতে সংশোধিত ফলে দেখা যায়, এ বিদ্যালয় থেকে কেউ মেধাবৃত্তি পায়নি। চারজন সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পেলেও ট্যালেন্টপুল বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর নাম সংশোধিত তালিকায় নেই। আবার আগে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছে, এমন দুজনের নাম বাদ পড়েছে। তাদের জায়গায় অন্য দুজনের নাম এসেছে, যার একজন স্থানীয় এক নেতার ভাগ্নি এবং অন্যজন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের ছেলে।

এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলী হোসেন কালবেলাকে বলেন, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খাতা দেখেছেন? না হলে এত বড় ভুল হয় কীভাবে? আবার যেসব খাতা দেখতে তাদের ৬০ থেকে ৬৫ দিন সময় লাগল, সেসব খাতা তারা এক দিনের মধ্যে কীভাবে সংশোধন করলেন? এসব কিছুই আমাদের কাছে ধোঁয়াশা মনে হয়েছে। এটি একটি প্রশ্নবিদ্ধ ফল। শিশুদের লেখাপড়া নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার তাদের নেই।

একই উপজেলার উদয়ন কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড স্কুলের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ সাইফুর রহমান বলেন, আমার প্রতিষ্ঠান থেকে ছয় শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষা দেয়। এর মধ্যে দুজন ট্যালেন্টপুলে এবং তিনজন সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পায়। সংশোধিত ফলে একজন সাধারণ আছে, বাকিগুলো বাদ। এ নিয়ে সবাই খুব হতাশ।

পটুয়াখালীর বাউফলের ইন্দ্রকুল হাইস্কুল সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দুই শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষা দেয়। এর মধ্যে প্রথম প্রকাশিত ফলে এক শিক্ষার্থী সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পায়; কিন্তু সংশোধিত ফলে তার নাম নেই। বিদ্যালয়টির শিক্ষক রেজাউল করিম কালবেলাকে বলেন, বৃত্তির তালিকায় নাম আসার পরও সেখান থেকে বাদ পড়ায় ছেলেটি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। স্কুলে আসবে না বলে জানিয়েছে।

তার পরিবার বলছে, সামনের বোর্ড পরীক্ষাগুলোতেও এমন হবে। এসএসসি পরীক্ষায় প্রথমে পাস করলেও পরে কারিগরি ত্রুটি দেখিয়ে বলবে সে ফেল করেছে।

ওই শিক্ষক বলেন, বৃত্তিপ্রাপ্তদের ফলাফলে কোনো ধরনের ফল পরিবর্তন আসবে না বলে জানিয়েছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী; কিন্তু তার কথাও তো রাখা হলো না। প্রাথমিক শিক্ষায় এসব কী হচ্ছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মন ভেঙে দিয়ে পড়াশোনার আগ্রহ কমিয়ে দেওয়ার বিচার কে করবে?

প্রাথমিকের বৃত্তির সংশোধিত ফলে সারা দেশেই এমন পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। অনেকেই আগে বৃত্তি পেলেও সংশোধিত তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হওয়ায় অনেক বিদ্যালয়ের বৃত্তিপ্রাপ্ত সংখ্যা হেরফের হয়ে গেছে। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের চেয়ে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। কিছু বিদ্যালয়ে আগে যে ফল ছিল, সংশোধিত তালিকায়ও একই আছে।

জানা গেছে, পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় গত বছরের ২৮ নভেম্বর এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বিদ্যালয়ের বাছাই করা ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নেবে এই পরীক্ষায়। পরে সেই সিদ্ধান্তেও পরিবর্তন আসে। ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর পরীক্ষার তারিখও দুবার পরিবর্তন করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সচিবালয়ে বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে কারিগরি ত্রুটির কারণ দেখিয়ে বিকেলে সেটি স্থগিত করা হয়। গত বুধবার রাতে ফল প্রকাশ করা হলেও সেটি নিয়ে এখন চলছে সমালোচনার ঝড়। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক অভিভাবক ও শিক্ষক। তাদের কেউ কেউ মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

কালবেলার কাছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, বেশিরভাগ জেলাতেই বৃত্তির ফলে হেরফের হয়েছে। রাজধানীর সূত্রাপুর থানার শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর মা নাসরিন মিমি বলেন, আমার মেয়ে প্রথমবার ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল; কিন্তু ফল সংশোধনের পর তার নাম আসেনি। সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের রাজানগর ব্র্যাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক ছাত্রের বড় বোন চায়না দাস বলেন, সংশোধিত ফল দেখে আমার ভাই খুবই মনমরা হয়ে গেছে। সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল; কিন্তু এখন তার নাম নেই। কিশোরগঞ্জের রশিদাবাদের রামদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর মা সাহারা সুবর্ণা বলেন, আমার মেয়ে প্রথমে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। পরে সংশোধিত ফলে তার রোল নম্বর আসেনি। একই অভিযোগ জানালেন বরিশালের ১৪ নম্বর বিল্ববাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা শান্তা ইসলাম রুপা, বগুড়ার ধুনটের এলাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর গৃহশিক্ষক তাহসান, সাতক্ষীরা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর মা জহুরা খাতুন।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের মতো বড় আয়োজনে আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল; কিন্তু তা না করায় শিক্ষার্থীদের ওপর ফল নিয়ে এর হেরফেরের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান কালবেলাকে বলেন, এ ধরনের পরীক্ষাই বৈষম্যমূলক। বৃত্তি প্রদানের উদ্দেশ্য দুটি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকলে সেটি কমিয়ে আনা এবং তার ভবিষ্যৎ পড়াশোনায় আগ্রহী করা।

প্রাথমিক স্তরে টাকার বিনিময়ে উৎসাহিত করার চেষ্টা ভুল সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীকে আগ্রহী করে তুলতে হবে তার শিক্ষার স্পৃহা বাড়িয়ে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য মেধাভিত্তিক বৃত্তি বিতরণও ভুল কনসেপ্ট। এটি আরেক ধরনের বৈষম্য বাড়াচ্ছে।

তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা এত কম বয়সে যে আঘাত পেল, এর নেতিবাচক প্রভাব পুরো জীবনভর থাকবে। এটি তাকে শিক্ষাবিমুখ করতে পারে। শারীরিক, মানসিকভাবে ডিস্টার্ভড হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। এর দায় কে নেবে, সে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।

তিনি আরও বলেন, সারা জীবন শিক্ষার্থীরা এই ট্রমা বয়ে বেড়াবে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত এসব শিক্ষার্থীকে কাউন্সেলিং করা এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়া। যারা শিশুদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, তাদের মতামত নিয়ে এসব কাজে আগানো দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. লাফিফা জামাল বলেন, কোডিংয়ের ভুলের কারণে ফলাফলে বিপর্যয় হবে, এটি কাম্য নয়। ফল প্রকাশের আগে আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে এ ধরনের জাতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

কারিগরি ত্রুটিকেই প্রধান সমস্যা মনে হয়েছে : তদন্ত কমিটির প্রধান

এদিকে ফলে ত্রুটি কেন হলো, তা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে গতকাল রাতে কমিটির প্রধান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) মোছা. নূরজাহান খাতুন বলেন, আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কারিগরি ত্রুটিকেই প্রধান সমস্যা মনে হয়েছে। আশা করছি, দু-তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।

ফল নিয়ে অসন্তোষ থাকলে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ আছে: সচিব

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে হঠাৎ করেই বৃত্তির ফল স্থগিত করা হলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের কাছে সাংবাদিকরা এ ব্যাপারে জানতে চান। তিনি বলেন, কোডিংয়ের সমস্যার কারণে এ ফল স্থগিত করা হয়েছে। এ সময় তিনি বৃত্তিপ্রাপ্তদের ফলে কোনো ধরনের ফল পরিবর্তন আসবে না বলেও জানান; কিন্তু সংশোধিত ফলে দেখা গেছে, অনেক শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়ে গেছে। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে গতকাল বিকেলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ কালবেলাকে বলেন, ফলে পরিবর্তন আসবে না, এটি মন্ত্রণালয় থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। কারিগরি ত্রুটির কারণে আমরা ফল স্থগিত করেছিলাম। পরে সংশোধিত ফলে কিছু পরিবর্তন এসেছে। বৃত্তির বিষয়টি যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর দেখে, কারও ফল নিয়ে অসন্তোষ থাকলে তারা চাইলে অধিদপ্তরে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দাজ্জালের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো যে সাহাবির

লোহাগড়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ / কুপিয়ে জখম ৩

চুয়াডাঙ্গায় হিট অ্যালার্ট জারি

৮০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা, সতর্কতা জারি

পাবলিশহার এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড পেলেন মিতিয়া ওসমান

৮৪ জন গ্রাউন্ড সার্ভিস এসিস্টেন্ট নিয়োগ দিল বিমান

প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের শাড়ি বন্ধুদের দিলেন ব্যারিস্টার সুমন

‘নতুন প্রজন্মের মাঝে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তাৎপর্য তুলে ধরার আহ্বান’

লক্ষ্য যাত্রী সেবার মানোন্নয়ন  / ৮৪ জন গ্রাউন্ড সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ দিল বিমান

নওগাঁয় সিআইডি পরিচয়ে চাঁদাবাজি, অতঃপর...

১০

ইন্দোনেশিয়ায় অগ্ন্যুৎপাতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ১১ হাজার মানুষকে

১১

প্রবাসীদের রেমিট্যান্স উন্নয়নের অন্যতম মূল চালিকা শক্তি : দীপু মনি

১২

প্রচণ্ড তাপদাহে অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যা করবেন

১৩

মেঘনায় জাটকা ধরায় ২০ জেলে আটক

১৪

হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠক / বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন

১৫

মদ বিক্রেতার হামলায় আহত হয়ে মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর

১৬

যৌন হয়রানির অভিযোগে শিক্ষক রিমান্ডে 

১৭

বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অভিবাসী পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার ২৪

১৮

সাভারে গ্যাস বিস্ফোরণে দগ্ধ ৩

১৯

বিএনপি-জামায়াত দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে : লিটন

২০
*/ ?>
X