রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। অনেকের প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রয়োজন নেই তারপরও বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। এমন ঘটনা ঘটেছে রাজউকের বেগুনবাড়ী খালসহ হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পে। প্রয়োজন ছিল না, তারপরও প্রকল্পের টাকায় বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন ১৬ কর্মকর্তা। এর মধ্যে ১১ জন চীন ও ভিয়েতনাম, দুজন চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং দুজন নেদারল্যান্ডস ও ক্রোয়েশিয়া গেছেন। তাদের প্রশিক্ষণ প্রকল্পের কোনো কাজে আসেনি বিধায় প্রশিক্ষণের পেছনে সরকারের ব্যয় করা ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৬৭২ টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সরকারের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) সর্বশেষ হিসাব-সংক্রান্ত কমপ্লায়েন্স অডিট (নিরীক্ষা) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৩ মার্চ পর্যন্ত এ নিরীক্ষা কার্যক্রম চলে। নিরীক্ষায় বিভিন্ন অনিয়েমের সঙ্গে রাজউকের বেগুনবাড়ী খালসহ হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের টাকায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, আইএমইডি ১৬ কর্মকর্তার বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণে অনিয়মটিও উঠে আসে। পরে নিরীক্ষা প্রতিবেদনের আপত্তি নিষ্পত্তি করতে ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর সচিবের দপ্তরে প্রতিবেদনসহ চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠির জবাব না পেয়ে ২০২১ সালের ১৮ মার্চ তাগিদপত্র পাঠানো হয়। তারপরও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। পরে নিরীক্ষা প্রতিবেদন ২০২২ সালের ২ জুন রাষ্ট্রপতির কার্যালয় পাঠানো হয়। প্রতিবেদনে ওই ১৬ কর্মকর্তাকে বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে সরকারি অর্থ অপচয়ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেগুনবাড়ী খালসহ হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের সাবেক পরিচালক (পিডি) বর্তমানে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (প্রজেক্ট অ্যান্ড ডিজাইন) এএসএম রায়হানুল ফেরদৌস কালবেলাকে বলেন, অডিট আপত্তির বিষয়ে আমরা জবাব দিয়েছি। প্রকল্প পরিচালক বা রাজউক চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলেই কাউকে ফরেন ট্রেনিংয়ে পাঠাতে পারেন না। এটি মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনে দেওয়া হয়। অনুমোদনের সময় মন্ত্রণালয় থেকেও প্রতিনিধি রাখা হয়। মন্ত্রণালয় থেকে যাদের রাখা হয় তারা তো টেকনিক্যাল পারসন নন। বিষয়টি যেহেতু মন্ত্রণালয় থেকে করা হয়, সেটি তারাই ভালো জানেন।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজউকের নিয়ন্ত্রণাধীন বেগুনবাড়ী খালসহ হাতিরঝিল এলাকার সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের প্রজেক্ট কমপ্লেশন রিপোর্টে (পিসিআর) প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত নেই। অথচ প্রকল্পের এক্সিকিউশন কাজে সম্পৃক্ত নন এমন ১৬ কর্মকর্তা বিদেশে প্রশিক্ষণে গেছেন। এর মধ্যে ১১ জন চীন ও ভিয়েতনাম, ২ জন চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং ২ জন গেছেন নেদারল্যান্ডস ও ক্রোয়েশিয়া। তাদের এ প্রশিক্ষণ প্রকল্পের কোনো কাজে আসেনি। তারা মূলত বেড়াতে গেছেন। অথচ তাদের প্রশিক্ষণের পেছনে সরকারের ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৬৭২ টাকা অপচয় হয়েছে।
নিরীক্ষাকালে পিসিআর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রকল্পের পার্ট-বি ইমপ্লেমেনটেশন পজিশন অংশের প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় করা হয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রশিক্ষণে মোট ৩৬ কর্মকর্তা বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৬ কর্মকর্তা প্রকল্পের এক্সিকিউশন কাজের সঙ্গে জড়িত নন। তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে জড়িত। এসব কর্মকর্তা টেকনিক্যাল কোনো ব্যক্তি নন। তাদের লব্ধ জ্ঞান প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কাজে লাগানোর কোনো সুযোগ নেই। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়াতে প্রকল্পের কোনো উপকার হয়নি। এসব কর্মকর্তা বিদেশে প্রশিক্ষণে যাওয়ায় সরকারের ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৬৭২ টাকা ক্ষতি হয়েছে। তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ দিয়ে সরকারি অর্থ অপচয়ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে তা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৬ কর্মকর্তার মধ্যে ১১ জন চীন ও ভিয়েতনামে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন। এ তালিকায় আছেন পরিকল্পনা কমিশনের জয়েন্ট চিফ মো. সায়েদুল হক, ইআরডির ডেপুটি সেক্রেটারি মোহাম্মদ শামছুল আলম, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অ্যাসিসট্যান্ট চিফ অনিমেশ সোম, প্রটোকল অফিসার মল্লিক এনামুল হক, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চিফ মো. মইনুল ইসলাম তিতাস, ইআরডির সিনিয়র অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি আকরামুজ্জামান, পরিকল্পনা কমিশনের সহকারী চিফ আবুল বকর মো. তৌহিদ, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি মো. আবু মাসুদ, গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর এপিএস মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, আইএমইডির অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর আব্দুল্লাহ আল মাসুদ। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়েছিলেন আইএমইডির চিফ শেখ নজরুল ইসলাম, পরিকল্পনা কমিশনের চিফ এসএম গোলাম আলী। এ ছাড়া নেদারল্যান্ডস ও ক্রোয়েশিয়া গিয়েছিলেন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারি মো. মাহমুদুল হক, আইএমইডির জয়েন্ট সেক্রেটারি মো. ফাহিমুল ইসলাম ও পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চিফ এএইচএম কামরুজ্জামান।
রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণের প্রতিযোগিতা চলে রাজউকের প্রকল্পে। প্রতিটি ট্যুরে রাজউকের নিজস্ব তহবিল থেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হয়। আবার এমন বিভাগের কর্মকর্তারাও প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণ করেন, যারা প্রশিক্ষণ নিয়ে এলেও রাজউকের কোনো কাজে আসে না। তারা শুধু ঊর্ধ্বতনদের খুশি করেই বিদেশ ভ্রমণের তালিকায় নাম যুক্ত করেন। এসব ট্যুরে তালিকাভুক্ত হতে কেউ কেউ নগদ অর্থ ঘুষ দিয়ে থাকেন। প্রশিক্ষণ বা স্ট্যাডি ট্যুরের নামে বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে কর্মকর্তারা কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এসব ভ্রমণ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।