
নরসিংদী জেলা রাজনীতিতে এক অশুভ ছায়া পড়েছে। ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দাপটে প্রাণ ভয়ে থাকতে হচ্ছে দলের ত্যাগী ও প্রবীণ নেতাদের। এই সন্ত্রাসীদের লালন করছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির কিছু নেতা। লুটপাট আর ব্যক্তিগত প্রভাব টিকিয়ে রাখতে রাজনীতিকরা পৃষ্ঠপোষকতা করছেন সন্ত্রাসীদের। ক্ষমতা আর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষকে প্রাণে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করছে না। ফলে জেলার রাজনীতি থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আদর্শ। ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের অপচেষ্টা চালাচ্ছে একটি শ্রেণি। সন্ত্রাসনির্ভর এ রাজনীতিতে সুযোগ নিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। দিন দিন অবৈধ অস্ত্রধারী ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে এ জেলা। ত্যাগী নেতাকর্মীদের পাশাপাশি এমন অপরাজনীতিতে হতাশ জেলার সাধারণ মানুষও।
সম্প্রতি এই নোংরা ও অপরাজনীতির শিকার হয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন শিবপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ খান। এর রেশ না কাটতেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নরসিংদী। এবার সন্ত্রাসীদের হিট লিস্টে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকন। সম্প্রতি খোকনের বাসভবনে প্রকাশ্যে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার রেশ না কাটতেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শিবপুরে ইটাখোলা নামক স্থানে হামলা চালিয়ে তার গাড়ি ভাঙচুর করে দলীয় সন্ত্রাসীরা। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণে বাঁচতে সেদিন ফাঁকা ফায়ার করতে হয় খোকনকে। এ ঘটনায় হামলাকারীরা বাদী হয়ে খোকনসহ প্রবীণ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করে। অথচ খোকনের অভিযোগ আমলে নেয়নি পুলিশ। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও নেতিবাচক আলোচনা চলছে।
এ ঘটনার দিনই ইটাখোলার শান্তি সমাবেশে স্থানীয় সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভূঞা মোহন ওসি ফিরোজ তালুকদারকে আরও সতর্ক হয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, শিবপুরে কখনোই এমন ঘটনা ঘটেনি। আমরা এসবের আর পুনরাবৃত্তি চাই না। অথচ পুলিশ সেদিন রাতেই খোকনের অভিযোগ আমলে নেয়নি। অথচ হামলাকারীর অভিযোগ আমলে নিয়ে খায়রুল কবীর খোকন ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক আবুল হারিছ রিকাবদারসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা নেয়।
এ ব্যাপারে জেলা ছাত্রদলের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান নাহিদ বলেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন হিসেবে চিহ্নিত জেলা
বিএনপির বিতর্কিত সদস্য সচিব কালো টাকা দিয়ে মনজুর এলাহী এখন রাজনীতি ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করছে। জনপ্রিয় পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার সঙ্গে জড়িত কিলার গ্রুপের সঙ্গে রয়েছে এই নেতার নিদারুণ সখ্য। রাজনীতি তাদের পেশা না হলেও ব্যবসায়িক এই নেতা জেলাজুড়ে রাজনীতির নামে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তিনি জেলার শীর্ষ সন্ত্রাসী মাইনউদ্দিন ও অভিদের দিয়ে বিএনপির দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালায়। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক জননেতা খোকনের কিছু হলে সরাসরি মনজুর এলাহী দায়ী থাকবেন বলেও অভিযোগ করেন এই বিদ্রোহী ছাত্রনেতা।
জেলা যুবদলের সভাপতি ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মহসিন হোনাইন বিদ্যুৎ বলেন, নরসিংদীর রাজনীতিকদের নির্বাসনে পাঠাতে চাচ্ছে দলছুট এক চোরাকারবারি। তার বিরুদ্ধে গ্যাস চুরি, জেলা পরিষদের জমিসহ সাধারণ মানুষের ভূমি জবর দখল ও হাড়িদোয়া নদকে দূষণের অভিযোগ রয়েছে। অবৈধ টাকা ছিটিয়ে সে সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করে মানুষকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। জেলায় ক্লিন ইমেজের রাজনৈতিক নেতাদের ওপর হামলা করে সব কিছু সে নিজের কবজায় আনার চেষ্টা করছে। অথচ তার বিরুদ্ধে একটি মামলাও হয় না। নরসিংদী জেলা বিএনপিতে তার মতো সুবিধাবাদী ও জাতীয় বীর খোকনবিরোধী নেতার কোনো প্রয়োজন নেই বলেও বলেন এই যুবদল নেতা।
নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক তিন ভিপি ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ জলিল, খবিরুল ইসলাম বাবুল ও ইলিয়াছ ভূঞা জানান, দেশব্যাপী নরসিংদী সম্প্রীতির রাজনীতির নগরী হিসেবে পরিচিত। বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা ছাড়া রাজনীতির ময়দানে এখানে কখনো তেমন কোনো হানাহানি হয়নি। সম্প্রতি কালো টাকা ছিটিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে খুনোখুনি লাগিয়ে নিজের আখের গোছানোর ফলে রাজনীতির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে এক ভূমিদস্যু। জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মনজুর এলাহীর প্রতি ইঙ্গিত করে তারা আরও বলেন, আমরা এমন প্রতিহিংসার রাজনীতি চাই না। এমন অপরাজনীতির ফলে জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জননেতা তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার, জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আলহাজ সুলতান উদ্দিন মোল্লা ও আবুল হারিছ রিকাবদার স্যারের মতো বর্ষীয়ান রাজনীতিকরা রাজনীতি থেকে অনেকটা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সদর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম হীরু (বীরপ্রতীক) এবং নরসিংদীর সাবেক পৌর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে লেগে থাকা বিরোধই জেলা আওয়ামী লীগে কলহের মূল কারণ। এই বিরোধের কারণে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা দলে-উপদলে বিভক্ত। শুধু তাই নয়, তাদের এ বিরোধের ফলে জেলাজুড়ে বহিষ্কার, পদচুত্য ও অব্যাহতির ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনার জের ধরেই শেষ পর্যন্ত গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুষ্কৃতকারীরা বাসায় ঢুকে প্রাণে মেরে ফেলার জন্য গুলি করে শিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ খানকে। এর আগে গত ২৫ বছর ধরে শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে থাকা এই নেতাকে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই হঠাৎ তাকে পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। এরপর তৃণমূলের কাছে তার জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে গেলেই তাকে খুন করার পরিকল্পনা হয়।
শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামসুল আলম ভূঞা রাখিল বলেন, গত সোমবার জেলা আইনশৃঙ্খলার মাসিক সভায় সভাপতি জেলা প্রশাসক আবু নঈম মোহাম্মদ মারুফ খান উপজেলা চেয়ারম্যান ও এ-সংক্রান্ত কমিটির সদস্য হারুনুর রশীদ খানের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। এমন ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য জেলা পুলিশ প্রধানকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও শিবপুর থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ২০১৮ সালে বর্তমান কোন্দেরপাড়া ভোটকেন্দ্রে এমপি মোহনের নির্দেশে সন্ত্রাসীরা সেদিন আমার ওপর হামলা চালায়। এ সময় আমার কর্মীরা আমাকে রক্ষা করতে এসে সন্ত্রাসীদের হাতে মারা যায় মিলন নামে এক কর্মী। এ ঘটনার পর আমি কোনো রকম প্রাণে বেঁচে গেলেও এই সুযোগে তারা সব ভোটকেন্দ্র দখল করে নেয়। ছিনিয়ে নেয় আমার নিশ্চিত বিজয়। পরে তারা বলপূর্বক নিহতের পরিবারকে দিয়েই আমার ছোট ভাইসহ আমাকে মিথ্যা খুনের মামলার আসামি করে অবশ্য পরে এ মামলায় আদালতে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হই। এরপর আবার সম্প্রতি উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি করে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে গেছেন। তিনি মারা গেলে হয়তো এ খুনের মামলায়ও আমাকে জড়ানোর চেষ্টা করা হতো। এ যাত্রায় তাদের এ চেষ্টা সফল না হওয়ায় এবার পুরোপুরি তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকন বলেন, আমাকে যারা হত্যা করতে চায়, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবিতে যারা আগুন দেয়–তাদের নিয়ে তো আমি আর রাজনীতি করতে পারি না। তারা প্রকাশ্যে বিএনপির ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করছে। আর গ্রেপ্তার করাচ্ছে আমাদের শান্তিপ্রিয় নিরীহ নেতাকর্মীদের। গত পরশুও তারা বিনা কারণে আমার ৭ নেতাকর্মীকে আটক করে জেলে দিয়েছে। অথচ সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে রাস্তায় তাণ্ডব চালাচ্ছে। তাদের আট করা হচ্ছে না।
ডাকসুর সাবেক এই জিএস ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, কেবল রাজনীতি করার অপরাধে আমার বিরুদ্ধে ৮০টি মামলা হয়েছে। পরিবার-পরিজন ছেড়ে গত ১৪ বছর ধরে আদালত আর জেলখানায়ই সময় কেটেছে আমার। আর কালো টাকার মালিকদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। রাজনীতি ছেড়ে দিলেও নিজেকে এমন অপরাজনীতিতে সম্পৃক্ত করব না ইনশাআল্লাহ। এদিকে যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মনজুর এলাহী বলেন, কোনো হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বিএনপি নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে যখন এত শত মামলা তখন আপনার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই নেই, এমনকি জেলেও যেতে হয়নি, এর কারণ কী?
এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুই দুইবার নরসিংদী সদর থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার কারণে হয়তো প্রশাসন তাকে একটু ভিন্ন চোখে দেখে । এ ছাড়া অন্য কিছু নয়।