হাতপাখায় দিনবদলের হাওয়া

হাতপাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা।
হাতপাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা।ছবি : কালবেলা

তালপাতার তৈরি হাতপাখা বাঙালির ঐতিহ্যেরই অংশ। খুব বেশি আগের কথা নয়, গ্রীষ্মের তাপদাহে মাঠের কাজ শেষে কৃষক যখন ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরতেন, তখন তাকে একটুখানি স্বস্তি দিতে বাঙালি বধূর হাতে উঠত তালপাতার হাতপাখা। পরম মমতার সেই পাখার বাতাসে জুড়াত কৃষকের মন। আবহমানকাল থেকেই তাই প্রিয় মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসার প্রতীক এ তালপাতার পাখা। সীমাহীন কষ্ট আর অপ্রাপ্তিকে পেছনে ফেলে স্বজনদের মাঝে ভালোবাসার এ ক্ষুদ্র বিনিময় সংসারকে করত প্রাণবন্ত আর শান্তিময়।

কালের বিবর্তনে তালপাতার পাখার ব্যবহার এখন নেই বললেই চলে। যান্ত্রিক সভ্যতার এ যুগে শহর কিংবা গ্রাম—সবখানেই লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। আঙুলের একটি মাত্র স্পর্শে এখন মাথার ওপর ঘুরতে শুরু করে বৈদ্যুতিক পাখা কিংবা শীতাতপ যন্ত্র। ফলে গ্রামীণ মেলা বা পহেলা বৈশাখ ছাড়া তালপাতার পাখার দেখা মেলাই দুরূহ হয়ে পড়েছে। ইদানীং বিদ্যুতের গোলযোগ কিংবা লোডশেডিং হলেই মানুষের স্বস্তির একমাত্র ভরসা হয়ে উঠেছে এ হাতপাখা।

প্রাচীন ঐতিহ্যের এ অংশটি এখানকার কারিগরদের বাপ-দাদার আদিপেশা। এ দিয়েই চলে তাদের জীবিকা। পুরুষরা মাঠের কাজের ফাঁকে আর নারীরা গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে তৈরি করেন পাখা। অনেকের একমাত্র পেশা এটি।

নগরায়ণের ছোঁয়ায় তালপাতার পাখার ব্যবহার কমে এলেও গ্রীষ্মের শুরু সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ততা দেখা দেয় বগুড়ার কাহালুর তালপাতার গ্রামগুলোতে। উপজেলার পাইকড়ের আড়োলা, আতালপাড়া ও যোগীর ভবনে আশ্বিন-কার্তিক মাস বাদে বছরের ১০ মাসই চলে পাখা তৈরি ও উপকরণ সংগ্রহের কাজ। গ্রীষ্মের আগমনের আগেই পাখা কেনার জন্য এখানে ছুটে আসেন রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা।

গ্রীষ্মের শুরুতে পাইকারদের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। এ সময় কেউ ঘরে, কেউবা বারান্দায়, আবার কেউ উঠানে বসে ব্যস্ত থাকেন পাখা তৈরিতে। একদিকে ছেলেরা বাঁশ কেটে ডাটি বানায় আর অন্যদিকে মেয়েরা সুঁই-সুতো দিয়ে চাকে বাঁধছেন তালপাতা। কেউ আবার ব্যস্ত রং-তুলির আঁচড়ে নকশায়। তাদের নিখুঁত হাতের ছোঁয়ায় তালপাতার পাখায় ফুটে উঠে বাঙালির লোকগাঁথা, নানা নকশা ও শিল্পকর্ম।

প্রাচীনকাল থেকেই এ গ্রামগুলোতে চলছে তালপাতার পাখা তৈরির কাজ। যোগীর ভবনে রয়েছে প্রাচীন আশ্রম ও মন্দির। বগুড়ার ইতিহাস বলে, প্রাচীন এ আশ্রম ও মন্দির যোগীদের দেবপুরী ছিল। ভারত বিভক্তির আগ পর্যন্ত এখানে আসা-যাওয়া ছিল বিভিন্ন দেশের কানফোট সাধু-সন্যাসী ও যোগীদের। তারা ব্যবহার করতেন ‘মরছল’ নামে ময়ূরের পালক দিয়ে তৈরি নকশি পাখা। পরবর্তী সময়ে ময়ূরের পালকের আদলে এখানে তৈরি হতে শুরু করে তালপাতার ডাটি পাখা।

গত শুক্রবার আতালপাড়ার পাখার কারিগর আব্দুল গফুরের বাড়িতে দেখা মিলল ঢাকার মিরপুরের মাজার রোডের পাইকার ইব্রাহিমের। বললেন, ৩০ টাকা দরে ৩ হাজার পাখা কিনেছি। গত বছরের তুলনায় এবার দাম প্রায় দ্বিগুণ হলেও কিনে নিয়ে যাচ্ছি ব্যবসা ধরে রাখতে। প্রতিবছরই পাখা কিনতে এখানে আসেন গফুর। সিজনে ১৫ দিন পরপর এখান থেকে পাখা কিনে ঢাকায় বিক্রি করেন।

কারিগর গফুর জানান, ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে ভাদ্র পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার পাখা বিক্রি করেন তিনই। এতে খরচ বাদ দিয়ে তার লাভ থাকে প্রায় দেড় লাখ টাকা। আড়োলা দক্ষিণপাড়ার আবদুর রাজ্জাক ও তার স্ত্রী মোফেলা দুজনই পাখা তৈরি করেন। সিজিনে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকার পাখা বিক্রি করেন। এতে তাদের প্রায় ২ লাখ টাকা লাভ হয়। আর সাইফুল ও তার স্ত্রী মমতা বেগম জানান, তাদের অন্য কোনো পেশা নেই। পাখা তৈরি করেই সংসার চলে তাদের।

আড়োলার কারিগর বাদশা মিয়া, হাফিজা, মমতাজ উদ্দিন জানান, আশ্বিন-কার্তিক মাস বাদে সারা বছরই তারা উপকরণ সংগ্রহ ও পাখা তৈরির কাজ করেন। রাসেদা, রেহেনা, মোজাফফর জানালেন, আমরা তৈরি করি পকেট পাখা। আড়োলা উত্তরপাড়ায় তৈরি হয় ঘুরকি পাখা ও যোগীর ভবনে তৈরি হয় ডাটি পাখা। আবার কেউ কেউ তৈরি করেন হরতন পাখা। তাদের মতে, প্রকারভেদে এ পাখাগুলো ১০ টাকা থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত করে বিক্রি হয়।

কারিগররা জানান, এখানকার কারিগরদের বাজার খুঁজতে হয় না। বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা এসে পাইকারি দরে পাখা কিনে নিয়ে যান বাড়ি থেকেই। অনেকে আগাম অর্ডারও দেন।

পাইকড়ের ইউপি চেয়ারম্যান মিটু চৌধুরী জানান, আড়োলা, আতালপাড়া ও যোগীর ভবনের প্রায় তিন শতাধিক পরিবার জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে পাখা তৈরি করে। কৃষিকাজ করলেও মূলত পাখা তৈরিই তাদের মূল পেশা।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com