
নীলফামারীর তানজিম (ছদ্মনাম) পড়াশোনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে। কৃষিকাজ করে সংসার চালানো বাবা প্রতি মাসে হাতখরচ পাঠান ৪ হাজার টাকা। বছরখানেক আগেও এই টাকায় পুরো মাস চলে যেত অনায়াসেই। তবে, বর্তমানে দ্রব্যমূল্য বাড়ায় হোটেলে খাওয়া বাদ দিয়ে হলের ডাইনিংয়ে খান।
এভাবেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মেলাতে তানজিমের মতো হিমশিম খাচ্ছেন জাবির অনেক শিক্ষার্থী। কেউ সকালের নাশতা ছেড়েছেন, তো কেউ মাছ-মাংস খাওয়া কমিয়ে খরচ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। কেউ আবার বটতলার দোকান ছেড়ে হলের ডাইনিং কিংবা ক্যান্টিনে খাচ্ছেন। এতে পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি বাড়ছে শিক্ষার্থীদের।
২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২৫ জন আবাসিক শিক্ষার্থীর ওপর চালানো এক জরিপ থেকে জানা যায়, দৈনিক ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার কিলোক্যালরির খাবারের প্রয়োজন থাকলেও জাবির শিক্ষার্থীরা গড়ে মাত্র ১ হাজার ৮২১ কিলোক্যালরির গ্রহণ করেন। অর্থনীতি বিভাগের ৪১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক রায়হান ওই জরিপ পরিচালনা করেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি পিস মুরগির মাংস আর দেড় প্লেট ভাতের জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যয় হতো সর্বোচ্চ ৩০ টাকা। এ ছাড়া রুই মাছ ৩০ টাকা, ডিমের তরকারি ১০ টাকা, ভাত প্লেটপ্রতি ৩ টাকা, ভাজি ৫ টাকা, সবজি ১০ টাকা, ভুনা ডাল ৫ টাকা ও গরুর মাংস ছিল ৪৫ টাকা। প্রতিদিন গড়ে ১০০ টাকায় ভালোভাবেই খাওয়া যেত। তবে এখন শুধু খাবারের ব্যয়ই বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ।
ক্যাম্পাসের খাবার দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, এই সময়ে এসে খাবারের জন্য প্রতি শিক্ষার্থীর দৈনিক খরচ আনুমানিক ২০০-২২০ টাকা। খাবারের দাম বাড়িয়ে মুরগির মাংস ৫০ টাকা, মাছ ৫০ টাকা, গরুর মাংস ১২০ টাকা, ডিম ২০ টাকা, ভাত ১০ টাকা, ভাজি ১৫ টাকা ও ডাল ১০ টাকা ধরা হয়েছে। ফলে খাবার ও আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে একজন শিক্ষার্থীর মাসে খরচ হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার টাকা। অসচ্ছল পরিবারের জন্য এ খরচ চালানো প্রায় অসম্ভব বলা যায়। তবে এর চেয়ে কমে চলতে খেতে হবে হলের ডাইনিংয়ে। যেখানে আগেরদিন রাতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা দামের দুটি কূপন কিনে পরদিন দুপুর ও রাতের খাবার পাওয়া যায়। এভাবেই দুইবেলা খাবার আর নাশতা মিলিয়ে ১০০ টাকায় সারা দিন পার করছেন অনেকেই। খরচ কমাতে ডাইনিংয়ের অপর্যাপ্ত খাবার খেয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন বাড়ছে। যদিও ওই খাবার নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগও অনেক। এ ছাড়া ডাইনিংয়ের খাবারে শিক্ষার্থীদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ না হওয়ার অভিযোগ তো আছেই।
শিক্ষার্থীরা জানান, কূপন দিয়ে দুপুরে এক পিস মাছ বা মুরগি এবং রাতে মাছ বা ডিমের তরকারি আর পর্যাপ্ত ভাত আর ডাল পাওয়া যায়। তবে, বাইরে খাবারের দাম বেশি হওয়ায় এই খাবার নেহায়েত বাধ্য হয়ে খেতে হয়।
বটতলার এক খাবার দোকানের মালিক জাকির হোসেন জানান, নিত্যপণ্যের দাম এত বেশি যে, কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত মূল্যে খাবার বিক্রি করতে পারি না। বাধ্য হয়ে দাম কিছুটা বেশি রাখতে হয়, যা নিয়ে প্রায়ই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মনোমালিন্য হয় বলেও স্বীকার করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের খাবারের দাম নির্ধারণে কাজ কনজিউমার ইউথ সোসাইটির সভাপতি মো. নাইম ইসলাম বলেন, আগের তালিকা অনুযায়ী দোকানদাররা খাবার বিক্রি করছেন না। বরং সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন মূল্যতালিকা দিতে অনুরোধ জানিয়েছে। বিষয়টির স্থায়ী সমাধান পেতে হলে ডাইনিংয়ে স্বল্পমূল্যে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করতে হবে প্রশাসনকে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তাজউদ্দিন শিকদার বলেন, পুরো দেশেই খাবারের দাম বেড়েছে। সক্ষমতা সাপেক্ষে ভর্তুকি দিয়ে হলের খাবারের মান উন্নত করা যেতে পারে। আবার শিক্ষার্থীরা চাইলে নিজেরা মেস হিসেবে খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে। তাতে স্বল্পমূল্যে নিজেদের পছন্দমতো খাবার খেতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নুরূল আলম বলেন, শিক্ষার্থীরা চড়া মূল্যে বাইরের খাবার খাবে, তা চাই না। তবে ডাইনিংয়ে যে পরিমাণ টাকায় শিক্ষার্থীরা খাবার কিনে খায় সে টাকায় মানসম্মত খাবার পরিবেশন সম্ভব হয় না। দ্রুত হলের প্রভোস্টদের বলব, যাতে বাজার মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে হলে উন্নতমানের খাবার পরিবেশনে উদ্যোগী হন।