৮-৯ বছর আগেও দেশে চার থেকে পাঁচ লাখ অতিথি পাখি আসত। এসব পাখির বেশিরভাগই সিলেট সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন হাইল-হাওর ও জলাভূমি মুখর করে রাখত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে আসা এসব অতিথি বা পরিযায়ী পাখির দল। অতিথি পাখির স্বর্গরাজ্যখ্যাত এই জেলাগুলোর জলাভূমি এখন অতিথি পাখিদের জন্য অনুপযুক্ত ও অনিরাপদ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারের (আইইউসিএন) পর্যবেক্ষণ বলছে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে অতিথি পাখির বসতি এলাকা ৩৫ শতাংশ কমেছে। মূলত টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, বাইক্কা বিল, উপকূলীয় এলাকা, নদীর চর ও দেশের অভ্যন্তরীণ বিল এবং জলাশয়গুলোতেই বসতি গড়ে তোলে পরিযায়ী পাখিরা। দেশে যে ৭১১ প্রজাতির পাখি দেখা যায়, এর ৩৮৮ প্রজাতিই পরিযায়ী।
অন্যান্য বারের মতো এ বছর ২-৩ ফেব্রুয়ারি পাখিশুমারি করে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, বন বিভাগ এবং আইইউসিএন। তাদের জরিপে দেখা যায়, এ বছর টাঙ্গুয়ার হাওরে ৬১ হাজার ১২৫টি এবং হাকালুকি হাওরে ২৫ হাজারটি পাখি আসে। দেশের উপকূলীয় এলাকা, পদ্মার চর ও অন্যান্য জলাভূমি মিলে ১ লাখ ২৫ হাজার ১১৫টি অতিথি পাখি আসে।
২০২০ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরে ৫১ হাজার ৩৬৮টি, হাকালুকি হাওরে ৪০ হাজার ১২৬টি পাখি এসেছিল। এ ছাড়া উপকূল, পদ্মার চর ও অন্যান্য জলাভূমি মিলে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫১৯টি অতিথি পাখি আসে। ২০১৯ সালে আসে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬৫টি।
অতিথি পাখির সবচেয়ে বড় অভয়ারণ্য হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওরে শীতকালে পাখির সংখ্যা কমার পেছনে হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করাকে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, হাওর ও জলাভূমিতে পাখির খাবার ও আবাসস্থল ধ্বংস করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে হাওরের বিলগুলোর নাব্য সংকট, ইজারাদার দ্বারা বিল শুকিয়ে মাছ আহরণ, হিজল, করচ বৃক্ষ উজাড়, জাল ও বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকার এসব কারণে দেশীয় পাখির সঙ্গে পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।
আইইউসিএনের জরিপ অনুযায়ী হাকালুকি হাওরে প্রতিবছর পাখির সংখ্যা দ্রুত কমছে। গত ২০ বছরে হাকালুকিতে পাখির আবাসস্থল কমেছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। ২০০০ সালের আগেও হাওরে প্রতিবছর গড়ে বিচরণ করেছে প্রায় ৭৫-৮০ হাজার পাখি। দেশের সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকির ৮০ শতাংশই মৌলভীবাজারে, বাকিটা সিলেটে অবস্থিত।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর হাওরের বিল ইজারা দেওয়া হয়। ইজারাদার দ্বারা বিলে লোকসমাগম, দিনরাত পাহারা, পানি শুকিয়ে বিলের মাছ আহরণ—এসব কারণে হাওর ও বিলের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে অতিথি পাখি আসা কমেছে। ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ও ‘রামসার সাইট’ হিসেবে ঘোষিত টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জের ধরমপাশা ও তাহিরপুর মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, মাছ ও পাখির অভয়ারণ্য টাঙ্গুয়ার হাওরকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে প্রশাসনকে আন্তরিক হতে হবে এবং মানুষকে সচেতন হতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, আইন থাকার পরও পাখি শিকার কমছে না। এখন হাওরে গোপনে আরও বেশি পাখি শিকার হয় এবং বিক্রি হয়।