
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নে তুলার গুদামে লাগা আগুন অবশেষে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফায়ার সার্ভিস, সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী ও বিজিবির ফায়ার ইউনিটের মোট ২৩ ইউনিটের চেষ্টায় ২৪ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। গত শনিবার রাত ৩টার দিকে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও গতকাল রোববার সকাল ১০টার দিকে তা পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়।
গত শনিবার সকালে উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নের ছোট কুমিরা বাইপাস রোড-সংলগ্ন হিঙ্গিরি পাড়ার একটি তুলার গুদামে আগুন লাগে। খবর পেয়ে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে। তবে সময়ের সঙ্গে আগুন ভয়াবহ আকার নিলে বিকেলে আরও সাতটি ইউনিট যুক্ত হয়। এরপর একে একে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবির ফায়ার ইউনিট তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তাদের সম্মিলিত চেষ্টায় রোববার সকালে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে বিকেল ৫টার সময়ও তুলার গাঁইটগুলো থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়।
গতকাল বিকেলে সরেজমিন দেখা যায়, গুদামের প্রথম দোতলা ভবন ও পেছনের লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে তৈরি টিনশেডও ভেঙে পড়েছে। ধ্বংসস্তূপের রূপ নিয়েছে গুদামের পুরো অবকাঠামো। তবে তখনো পুড়ে যাওয়া তুলার গাঁইট থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল।
এদিকে আগুন লাগার ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে গণমাধ্যমকে কিছু জানায়নি মালিকপক্ষ। তবে ফায়ার সার্ভিসের সীতাকুণ্ড স্টেশন কর্মকর্তা নুরুল আলম দুলাল বলেন, ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা বেশি হবে বলে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের জানিয়েছে মালিকপক্ষ। তদন্ত হলে মূল ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।
পানি সংকটে বেগ পেতে হয় আগুন নিয়ন্ত্রণে: জানা গেছে, অগ্নিকাণ্ডে ঘটনাস্থলের আশপাশের পানির উৎস শেষ হয়ে যাওয়ায় আগুন নেভাতে বিপাকে পড়েছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। বাধ্য হয়ে ২-৩ কিলোমিটার দূরের পুকুর থেকে পানি আনতে হয়েছে তাদের। এ সময় নেমসন কনটেইনার ডিপো পানির ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা করেনি। দুপুর ১টার দিকে তাদের কনটেইনার ডিপোতে আগুন ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখে ডিপো কর্তৃপক্ষ পানি সরবরাহের সুযোগ দেয়।
কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি টিম এসে আগুন নেভাতে শুরু করে। কয়েক ঘণ্টা পর পানির সংকট দেখা দেয়। অনুমোদন ছিল না ওই গুদামের : স্থানীয় চেয়ারম্যান ও থানা পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, তুলার গুদাম করতে যেসব সরঞ্জাম থাকা দরকার, তা ছিল না। পরিবেশ অধিদপ্তর, সেফটি প্ল্যান, উপজেলা প্রশাসনসহ ইউনিয়ন পরিষদের কোনো ছাড়পত্রও ছিল না। এমনটি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্সও নেয়নি গুদামের মালিকপক্ষ।
সীতাকুণ্ড কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোরশেদ হোসেন চৌধুরী বলেন, দেশ স্বাধীনের পর মর্ডান জুট মিলস নামে একটি কারখানা ছিল সেখানে। পরে সিপি কারখানা হয়। সিপি কারখানা বন্ধ হওয়ার পর স্থানীয় জাহাজভাঙা কারখানা এস এল স্টিলের মালিক লোকমান হোসেন সেটি কিনে নেন। পরে তুলার গুদামের জন্য ভাড়া নেন ইউনিটেক্স স্পিনিং মিলস নামে একটি সুতার কারখানা। ব্যবসা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে গুদামের মালিকপক্ষ কোনো লাইসেন্স নেয়নি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে।
সীতাকুণ্ডের ইউএনও মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, জেলা প্রশাসকের গঠন করা তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করছে। ওয়েল্ডিং থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে বলে জানা গেছে। গতকাল বিকেলে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক বলেন, সকালে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও দুপুরের দিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তুলার গাঁইটগুলো থেকে ধোঁয়া বের হওয়ায় ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট পর্যবেক্ষণে অপেক্ষায় আছে।
বিমানবাহিনীর ফায়ার ইউনিটের কমান্ডার নাদেরুজ্জামান জানান, তারা এসে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করেছেন। দূর থেকে পানি এনে আগুন নির্বাপণে কাজ করেছেন। এখন আর দৃশ্যমান কোনো আগুন নেই। আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ করা হয়েছে।
সীতাকুণ্ড শিল্পাঞ্চলের নতুন ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের দাবি : চট্টগ্রাম নগরের সিটিগেট সংলগ্ন সীতাকুণ্ড উপজেলার তিন ইউনিয়নের মধ্যে কোনো ফায়ার স্টেশন নেই। এই তিন ইউনিয়নে ১৭৯টি জাহাজভাঙা কারখানাসহ ৪৫০টি শিল্প কলকারখানা রয়েছে। দোকানপাট ও বসতবাড়ির সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। নিকটতম ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ২৫ কিলোমিটার দূরে থাকায় দুর্ঘটনা তাৎক্ষণিক রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক সময় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে আসার আগেই সর্বস্ব হারাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
জাহাজভাঙা শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআর) সহসভাপতি ও সীতাকুণ্ড উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম আল মামুন বলেন, এত বিশাল একটা এলাকায় এত বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। যখন কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এত বসতি কিংবা এত শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল না। তাই তিন ইউনিয়নের মধ্যে যে কোনো স্থানে একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপনের দাবি জানান তিনি।
এর আগে গত ৪ মার্চ বিকেলে উপজেলার সোনাইছড়ির কেশবপুর এলাকায় সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণে সাতজন নিহত ও অর্ধশত আহত হন। এর আগে গত বছরের ৪ জুন রাতে একই এলাকার বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে অন্তত ৫০ জন নিহত হন আর আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। সর্বশেষ শনিবার সকালে কুমিরা ইউনিটেক্স তুলার গুদামে আগুনের ভয়াবহতা পুরো এলাকাকে কাঁপিয়ে তোলে।