আদালতে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন ৬০০ নারী বিচারক

সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্ট।পুরোনো ছবি

হাজারো বিধিনিষেধের দেয়াল ভেঙে, ঝড়-ঝঞ্ঝা পাড়ি দিয়ে নারীরা অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছেন। সব ক্ষেত্রেই লক্ষ্যণীয় নারীর অগ্রযাত্রা। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তকমা ছুড়ে ফেলে নারীরা এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রমাণ রেখেছেন নিজের সক্ষমতার। এরই অংশ হিসেবে নারীরা পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের বিচার বিভাগেও। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সারা দেশে প্রায় ৬০০ নারী বিচারক কাজ করছেন। বিচারকের আসনে বসে তারা প্রতিনিয়ত ছড়াচ্ছেন ন্যায়বিচারের দ্যুতি।

তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের নারীরা বিচারক হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও তা বিসর্জন দিতে হয়েছে। এই বাধাটা ছিল রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই। কেননা, ওই সময় পর্যন্ত নারীদের বিচারক হওয়ার পদে পরীক্ষা দেওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। তবে ১৯৭৪ সালে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। পরের বছর বিচার বিভাগে বিচারক হিসেবে নারীর আগমন ঘটে। ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রথম নারী বিচারক (মুনসেফ) হিসেবে যোগ পান নাজমুন আরা সুলতানা। এরপর মুনসেফ হিসেবে নাজমুন আরা সুলতানা খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮২ সালে সাব-জজ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে তিনি টাঙ্গাইল ও ফরিদপুরে পাঁচ বছর কাজ করেন। কয়েক দফা পদোন্নতির পর ১৯৯১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা জজ হিসেবে যোগ দেন। কোনো নারীর জেলা জজ হওয়ার ঘটনা সেটিই প্রথম। ২০০০ সালের ২৮ মে তিনি হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এর দুই বছর পর হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হন তিনি। সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি আপিল বিভাগে প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগেও প্রথম নারী বিচারপতি তিনিই। অধস্তন আদালত থেকে হাইকোর্ট, এরপর আপিল বিভাগে দায়িত্ব পালন শেষে বিচারপতি হিসেবে ২০১৬ সালে অবসরে যান তিনি।

দীর্ঘ কর্মজীবনে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা একজন নারী বিচারক হিসেবে রেখে গেছেন সফলতার স্বাক্ষর। অনেক আলোচিত রায় দিয়েছেন। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার পর সর্বোচ্চ আদালতে আরও দুজন নারী বিচারপতি দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা হলেন বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। তারা দুজনও অবসরে গেছেন। তবে বর্তমানে আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতিসহ ৮ জন বিচারপতি দায়িত্ব পালন করলেও কোনো নারী বিচারপতি নেই। আর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মোট ৯১ জন বিচারপতি কাজ করছেন। এর মধ্যে নারী বিচারপতির সংখ্যা বর্তমানে ৭ জন।

তারা হলেন : বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি কাশেফা হোসেন, বিচারপতি ফাতেমা নজীব, বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারতি ফাহমিদা কাদের।

বিচারপতি সালমা মাসুদ ছাড়া ছয়জন বিচারপতিই হাইকোর্টের দ্বৈত ও একক বেঞ্চে বিচারকাজ পরিচালনা করছেন। বর্তমানে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন দ্বৈত বেঞ্চের নেতৃত্বে রয়েছেন। রিট, ফৌজদারি মোশন ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ সংক্রান্ত মামলার শুনানি গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করছেন দ্রুততার সঙ্গে। দিচ্ছেন বিভিন্ন মামলায় যুগান্তকারী রায়। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বিচারপতি নাইমা হায়দার।

বর্তমানে দেশের অধস্তন আদালতে মোট বিচারক রয়েছেন প্রায় দুই হাজার। এর মধ্যে নারী বিচারক ৫৮০ জন। সবাই বিচারের গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ, যুগ্ম জেলা জজ, সিনিয়র সহকারী জজ ও সহকারী জজ এবং বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তারা। শুধু বিচারের দায়িত্বই নয়, বিচার বিভাগ থেকে প্রেষণে আসা অনেক নারী বিচারক প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করছেন সফলতার সঙ্গে। তাদের অনেকেই আছেন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন, আইন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে।

অধস্তন আদালতে নারী বিচারকের অগ্রযাত্রার মূল্যায়ন জানতে চাইলে বাংলাদেশের প্রথম নারী বিচারক ও আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা কালবেলাকে বলেন, ‘বিচার বিভাগে নারীর অগ্রযাত্রা বেশ ভালো। নারীরা ভালো বিচার করছে। ভালো কাজ করছে। প্রথমদিকে যে ধরনের প্রতিকূলতা ছিল, এখন সেই প্রতিকূলতা নেই। আশা করি, সামনের দিকে তারা আরও ভালো করবে। আরও অনেক বেশি সংখ্যক বিচারক উচ্চ আদালতে স্থান করে নেবে।’

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com