আতাউর রহমান
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৫ এএম
আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তবু আত্মবিশ্বাসী বিমান

থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং
সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তবু আত্মবিশ্বাসী বিমান

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অত্যাধুনিক থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পাবে কে, তা নিয়ে আলোচনা চলছিল ওই প্রকল্পের শুরু থেকেই। যাত্রীসেবার মান বাড়াতে বিশেষজ্ঞ মত ছিল, রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সঙ্গে দ্বিতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়া হোক এই দায়িত্ব। বিভিন্ন সময়ে বিমানের সঙ্গে বিদেশি অন্য প্রতিষ্ঠানকে এই দায়িত্ব দেওয়ার কথা জানিয়েছিল বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিভিল এভিয়েশন অথরিটি। তবে বিমানকেই দুই বছরের জন্য এই দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সম্প্রতি এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে সংস্থাটিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

এককভাবে বিমান দায়িত্ব পাওয়ায় ফের থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমান এই দায়িত্ব পাওয়ায় দেশের টাকা দেশে থাকবে, এটা ঠিক। তবে চালুর অপেক্ষায় থাকা অত্যাধুনিক ওই টার্মিনালে প্রতিষ্ঠানটির শতভাগ সেবা দেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ৫৪ বছর ধরে দেশের বিমানবন্দরগুলোয় একমাত্র বিমান এই সেবা দিলেও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ১ ও ২ নম্বর টার্মিনালে সংস্থাটিকে হিমশিম খেতে দেখা গেছে। বিমানের আয়ের একটি বড় অংশ আসে এই সেবা থেকে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে আন্তর্জাতিক মানের সেবা দিতে ব্যর্থ হলে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো তাদের অপারেশন নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করতে পারে। যাত্রীরাও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। এতে বাধার মুখে পড়তে পারে ঋণের টাকায় করা এই প্রকল্পে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায়।

অবশ্য বিমান বাংলাদেশ বলছে, থার্ড টার্মিনালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দিতে তারা পুরোপুরি প্রস্তুত। গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক মানের প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম কেনার পাশাপাশি কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে কর্মীদের।

গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বলতে যাত্রীর বোর্ডিং পাস ইস্যু, উড়োজাহাজ অবতরণের পর পথ দেখিয়ে পার্কিং বেতে নেওয়া, দরজায় সিঁড়ি লাগানো, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাগেজ আনা-নেওয়া, উড়োজাহাজের ভেতর পরিষ্কার করাসহ এয়ারক্রাফটের সব ধরনের সেবাকে বোঝায়। ১৯৭২ সাল থেকে দেশের সব বিমানবন্দরে এককভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করছে বিমান। নিজেদের ফ্লাইটের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি ৩৫টির মতো এয়ারলাইন্সকে এই সেবা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে নানা সময়ে এই সেবায় যাত্রী ও এয়ারলাইন্সগুলোকে অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

সিভিল এভিয়েশন অথরিটি (বেবিচক) সূত্র জানায়, থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার কারা হবে, তাদের কীভাবে কী সেবা দিতে হবে, রাজস্ব আয় কত হবে—এসব বিষয় নির্ধারণে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি) অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। প্রাথমিক প্রতিবেদনে থার্ড টার্মিনালের প্রাইভেট সেক্টর পার্টনারশিপের (পিএসপি) জন্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। তা ছাড়া শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের এক জরিপেও ৯০ শতাংশের বেশি যাত্রী বিমানের সেবা নিয়ে তাদের নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। এমন পরিস্থিতিতে বিমানের সঙ্গে থার্ড টার্মিনালে বিনিয়োগকারী জাপানকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন বেবিচকের তৎকালীন কর্মকর্তারা।

বেবিচকের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মফিদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে থার্ড টার্মিনাল তৈরি হয়েছিল যাত্রীদের আন্তর্জাতিক সেবা দেওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে। এই সেবা দিতে গেলে এখানে একাধিক গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার দরকার। এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে, যাত্রীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাবে। সেই ভাবনা থেকেই নানা জরিপ প্রতিবেদনের আলোকে থার্ড টার্মিনালে একাধিক গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার রাখার চিন্তা ছিল। তা ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিন থেকে চারটি প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে এই সেবা দেয়।

তিনি বলেন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে গত কয়েক বছরে বিমানের সক্ষমতা বাড়লেও থার্ড টার্মিনালের মতো বড় পরিসরের টার্মিনালের সেবা দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষিত কর্মী রয়েছে কি না, সেটাও ভাবতে হবে। বর্তমান সক্ষমতা নিয়ে বিমান প্রত্যাশিত সেবা দিতে পারবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া ঋণের টাকায় করা এই টার্মিনাল থেকে রাজস্ব আদায় করে তা পরিশোধ করতে হবে। বিমান শুধু এককভাবে হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পেলে কাঙ্ক্ষিত আয় নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম কালবেলাকে বলেন, সব যাত্রীরই প্রত্যাশা থাকে সর্বোচ্চ সেবা পাওয়ার। বিমান ৫৪ বছরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে কতটা সেবা দিতে পেরেছে, তা সবাই জানে। বারবার বলার পরও সেবার মান বাড়েনি। এখন থার্ড টার্মিনালে যাত্রীর সঙ্গে বাড়বে সেবার ক্ষেত্রও। সেক্ষেত্রে বিমান এই সেবা দিতে কতটা সক্ষম, সে প্রশ্নও থাকছে।

তিনি বলেন, আমরা সবাই চাই রাষ্ট্রীয় কোম্পানি হিসেবে বিমান এই দায়িত্বে থাকুক। কিন্তু এখানে সেবা নিয়েও প্রশ্ন আসে। বিমান একক সংস্থা হিসেবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পালন করলে এখানে কোনো প্রতিযোগিতা থাকবে না। ফলে নানা খাতে চার্জ বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে টিকিটের দামে। তা ছাড়া উন্নত সেবার জন্য প্রতিযোগিতার বিকল্প নেই।

থার্ড টার্মিনাল প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বিমান পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে প্যাসেঞ্জার হ্যান্ডলিং করতে পারলেও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কারণ, এই টার্মিনালে কার্গো হ্যান্ডলিং ব্যবস্থা প্রায় পুরোটাই প্রযুক্তিনির্ভর।

শাহজালাল বিমানবন্দরে ফ্লাইট অপারেশনে থাকা একাধিক বিদেশি এয়ারলাইন্সের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, থার্ড টার্মিনালে তারা নিজেদের পছন্দমতো গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং প্রতিষ্ঠান পাওয়ার প্রত্যাশায় ছিলেন। কিন্তু বিমান এককভাবে সেই দায়িত্ব পাওয়ায় হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।

বিদেশি এয়ারলাইন্সের প্রতিনিধি ও এজেন্টরা বলছেন, চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী সরবরাহ করার কথা। কিন্তু বিমান থেকে টার্মিনাল-১ ও ২-এ তা পাওয়া যায় না। এজন্য এয়ারলাইন্সগুলো চুক্তির বাইরে নিজস্ব কর্মী নিয়োগ দিয়ে আসছে। তা ছাড়া গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সরঞ্জাম ব্যবহারেও চুক্তির বাইরে ‘বকশিশের’ নামে অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে কর্মীদের। তা না দিলে সময়মতো এসব সরঞ্জাম পাওয়া যায় না। এতে খরচ বাড়ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে টিকিটের মূল্যে।

বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘থার্ড টার্মিনালে সেবা দিতে সব ধরনের সক্ষমতা রয়েছে বিমানের। তবে যাদের স্বার্থ রয়েছে, তারা অন্যদের হাতে এই দায়িত্ব তুলে দিতে চায়।’

বিমানের মুখপাত্র বলেন, থার্ড টার্মিনালে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় কর্মী নিয়োগ দিয়ে জাইকার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে বিমান। আন্তর্জাতিক মানের সেবা দিতে সব ধরনের অত্যাধুনিক সরঞ্জামও রয়েছে বিমানের কাছে। থার্ড টার্মিনালে সেবা দিতে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।

বিমানের কর্মকর্তারা বলছেন, থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বাড়াতে ওই প্রকল্পের কাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কর্মীদের সক্ষমতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ছাড়াও অত্যাধুনিক বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সক্ষমতার উন্নয়নে বিভিন্ন ধাপে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেগুলোর বেশ কিছু এরই মধ্যে বহরে যুক্ত হয়েছে। বহরে বর্তমানে দুই হাজারের মতো মোটরচালিত ও হস্তচালিত যন্ত্রপাতি রয়েছে, আছে ২৬টি বেল্টলোডার। এ ছাড়া হাইলোডার, কনটেইনার প্যালেট ট্রান্সপোর্টার, এয়ার কন্ডিশনিং ভ্যান, প্যাসেঞ্জার স্টেপ, ওয়াটার কার্ট, ফ্লাশ কার্ট, অ্যাম্বুলিফটসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি কেনার কাজ চলছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রতিটা মিনিট এই পৃথিবীকে উপহার দাও : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

৩৫ লাখ বেতনে চাকরি দিচ্ছে কানাডা হাইকমিশন

নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করবে মিত্র যুক্তরাজ্য

স্বামীকে গোপন ভিডিও-ছবি পাঠাল সাবেক প্রেমিক, নববধূর আত্মহত্যা

নতুন যে সুবিধা পাওয়া যাবে গুগল লেন্সে 

রমজানে বাজার সহনশীল করার চেষ্টা করা হচ্ছে : বাণিজ্য উপদেষ্টা

অন্তর্বর্তী সরকার ফেল করলে আমার-আপনার বিপদ আছে : এ্যানি

অর্থমন্ত্রী পদে বিলিয়নিয়ারকে বেছে নিলেন ট্রাম্প

‘বিএনপি সবসময় নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে’

‘৭০-এর অনুচ্ছেদ বাতিল করে হাত তোলা এমপি বাদ দিতে হবে’

১০

আরও সেন্ট্রিফিউজ চালু, পরমানু অস্ত্র তৈরি শুরুর ইঙ্গিত ইরানের?

১১

সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরামর্শ

১২

বৃদ্ধার ভাতার টাকা ইউপি সদস্যের পকেটে

১৩

মেসি যাচ্ছেন না বার্সার অনুষ্ঠানে

১৪

‘শিবিরের নামে অপপ্রচার ভিত্তিহীন’

১৫

ড্রেনের ওপর ঢালাই দিয়ে রাস্তা বৃদ্ধি

১৬

জানা গেল অক্টোবর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা

১৭

অন্তর্বর্তী সরকারকে সঠিক ইতিহাস নির্ধারণের আহ্বান মঈন খানের

১৮

ফার্মগেটে ব্যাংকের বেজমেন্টে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৫ ইউনিট

১৯

আগে স্থানীয় পরে জাতীয় নির্বাচনের পরামর্শ

২০
X