রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) বহরে ১৯৮৭ সালে যুক্ত হয় ডেনমার্ক থেকে আনা দুটি তেলবাহী জাহাজ ‘বাংলার জ্যোতি’ ও ‘বাংলার সৌরভ’। মূলত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আমদানি করা তেল গভীর সমুদ্র থেকে খালাস করে চট্টগ্রাম বন্দরের ডলফিন জেটিতে আনার কাজ করত ট্যাঙ্কার দুটি। সাধারণত একটি তেল ট্যাঙ্কারের ২৫ বছর পর্যন্ত ‘লাইফটাইম’ থাকলেও জাহাজ দুটি ‘রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে’ ৩৭ বছর ধরে অপারেশনাল কার্যক্রমে ছিল।
এক বছর আগে জাহাজ দুটি স্ক্র্যাপ হিসেবে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে পরে তা থেকে সরে এসে ফের জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু করে বিএসসি। পুরোনো হওয়ায় উচ্চমূল্যে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে সচল রাখার চেষ্টার মধ্যে পাঁচ দিনের ব্যবধানে ট্যাঙ্কার দুটিতে বিস্ফোরণের পর আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় জাহাজ দুটির মোট চার নাবিক প্রাণ হারান। ট্যাঙ্কার দুটি অনেক বেশি পুরোনো হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় দেশের সমুদ্রসীমার বাইরে যাওয়ার পর্যায়েও ছিল না। এর পরও ঝুঁকি নিয়ে চলাচলের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অবশেষে বিএসসি তাদের জাহাজ দুটি সমুদ্র পরিবহন থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে এসব ঘটনায় ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া বিএসসির এমডি কমডোর মাহমুদুল মালেকের কিছু বক্তব্য নিয়েও ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। অগ্নিকাণ্ডের পর বাংলার জ্যোতিতে ত্রুটি বা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটেনি দাবি করেন বিপিসির এমডি। অথচ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, স্ক্র্যাপিং না করেই ত্রুটিপূর্ণ জাহাজটি ব্যবহার করা হচ্ছিল ক্রুড লাইটারিংয়ে কাজে, যে কারণে সোমবার চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় তেলবাহী জাহাজটিতে ঘটে বিস্ফোরণ। এর পাঁচ দিন পরই ঘটে আরেক দুর্ঘটনা, আগুন লাগে আরেকটি জাহাজ ‘বাংলার সৌরভে’। তখন তিনি বলেছিলেন, বাংলার সৌরভে কোনো ধরনের বিস্ফোরণ হয়নি। আবার আগুন লাগার সময় জাহাজের পাশ দিয়ে একটি স্পিডবোটও চলে যেতে দেখা যায়। সব মিলিয়ে ঘটনাটিকে নাশকতা বলে ধারণা করেন তিনি।
এরপর গতকাল সন্ধ্যায় তিনি কালবেলাকে বলেন, ওই বোট দিয়ে নাশকতা করানোর মতো কোনো ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। যদি নাশকতা হতো তাহলে আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকতে হবে। তাই ওই বোটের সঙ্গে আমার মনে হচ্ছে এখন কোনো সম্পর্কই নেই।
এদিকে পরপর দুটি জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর রোববার চট্টগ্রামে বিএসসি কার্যালয়ে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, পরপর দুটি ঘটনায় স্বাভাবিকভাবে মানুষের মনে একটা সন্দেহ থাকতে পারে। স্বাভাবিকভাবে আমরা যে সময়টাতে আছি, এটা তো একটু অস্থির সময়। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করছি এ অস্থিরতাটা কমাতে।
এক শিপিং ব্যবসায়ী বলেন, ত্রুটির কারণে মেয়াদোত্তীর্ণ জাহাজে আগুন লাগা এক বিষয়। নাশকতা আরেক বিষয়। তবে বিদেশি ব্যবসায়ীরা তখনই বিষয়টি নিয়ে ভাববেন, যখন এখানে নাশকতা হবে। এরই মধ্যে ওই বক্তব্যের সূত্র ধরে ভারতের একটি পত্রিকা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে জঙ্গি হামলা হয়েছে বলে সংবাদ পরিবেশন করেছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহসভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এলোমেলো কথা বলা উচিত নয়। সব থেকে বড় ব্যাপার হলো, ‘বাংলার জ্যোতি’ কিংবা ‘বাংলার সৌরভে’র মতো ত্রুটিপূর্ণ জাহাজ যেন মোহনা পর্যায়ে না থাকে, সেই ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ এ পথ ধরেই অনেক জাহাজ যাতায়াত করে, দেশের সিংহভাগ আমদানি-রপ্তানিই এই বন্দরের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) পরিচালক ফজলুল ইমরান খান কালবেলাকে বলেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। এখানে না জেনে বা বুঝে কমেন্ট করে তিনি বোকার পরিচয় দিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা তার এই ধরনের এলোমেলো কথার কারণে খুবই উদ্বিগ্ন। দুর্ঘটনা হতেই পারে। কিন্তু পরপর দুটি ঘটনা যেহেতু ঘটেছে, এখন তো এটি একটি রেড অ্যালার্ট হবেই। যত দ্রুত সম্ভব সঠিকভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
বাংলাদেশ শিপিং অ্যাজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএএ) চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, তদন্ত ছাড়াই এই অগ্নিকাণ্ডের বিষয় নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার বিষয়টি আমরা কোনোভাবেই সমীচীন মনে করি না। চট্টগ্রাম বন্দরে যেখানে ছোটখাটো চুরি হলেও কোস্টগার্ড, বন্দর কর্তৃপক্ষ অস্থির হয়ে যায়, সেখানে এমন বক্তব্যের কারণেই আমার মনে হয় আন্তর্জাতিকভাবে আমরা রেড জোনে পড়ে যাব।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহসভাপতি খাইরুল আলম সুজন বলেন, প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিকেই দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে হবে। কিন্তু আসলেই যদি পরপর দুটি নাশকতা হয়, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টদের দ্রুত তদন্ত করে এর পেছনের রহস্য বের করতে হবে।