জাল কাগজে স্ত্রীর নামে আদিবাসী কোটায় প্লট

দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যালয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যালয়।পুরোনো ছবি

জাহানারা বেগমের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার আলমপুর গ্রামে। তার স্বামী রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মচারী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল আকন্দের বাড়ি শেরপুরে। তিনি জাল কাগজপত্র সৃষ্টির মাধ্যমে স্ত্রী জাহানারা বেগমের নামে পূর্বাচল প্রকল্পে আদিবাসী কোটায় ৩ কাঠা আয়তনের প্লট বরাদ্দ নেন। তাকে জাল-কাগজপত্র তৈরিতে সহায়তা করেন রাজউক ও ডিসি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে এ তথ্য উঠে আসে।

রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আব্দুল জলিল আকন্দ রাজউকের গাড়িচালক হলেও তিনি ছিলেন খুবই প্রভাবশালী। তিনি রাজউক কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং শ্রমিক লীগ রাজউক শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কর্মচারী নেতা হওয়ায় তিনি প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন প্লট ও ফ্ল্যাটের ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদন চক্রের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। তিনিসহ আরও কয়েকজন নেতা গোল্ডেন মনিরের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। তাদের সহযোগিতায় গোল্ডেন মনির রাজউকের বিভিন্ন প্রকল্পের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা মূল্যের ৪১টি প্লট হাতিয়ে নিয়েছেন। রাজউকে চাকরি করাকালে তিনি প্রভাব খাটিয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। বছর তিনেক আগে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন।

দুদকের তথ্য বলছে, আব্দুল জলিল আকন্দ রাজউকের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তার স্ত্রী জাহানারা বেগমের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার আলমপুরে। আব্দুল জলিল আকন্দ নিজের প্রভাব খাটিয়ে অন্যদের সহায়তায় জাল কাগজপত্র সৃষ্টির মাধ্যমে প্রথমে তার স্ত্রীকে গাজীপুর জেলা সদরের আলমপুর গ্রামের বাসিন্দা দেখান। সেখানকার আশ্বীন কুমার গংয়ের গুতিয়ব মৌজার আরএস ২২৫, ২২৬, ২২৭ ও ২২৮ দাগের জমি তার স্ত্রীর বসতবাড়ি দেখান। পরে আদিবাসী কোটার অধীনে এবং পূর্বাচল নিউ সিটির উন্নয়ন কাজের ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৩ কাঠা জমির জন্য রাজউকের কাছে আবেদন করেন জাহানারা বেগম। আবেদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দাগের অ্যাওয়ার্ড, নাগরিক সনদ, হলফনামা, ট্যাক্স আদায়ের রসিদ, জনতা ব্যাংকের পে-অর্ডার যুক্ত করেন, যা ছিল জাল। রাজউকের পূর্বাচল সেলের তৎকালীন উপপরিচালক (পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব) মো. সাইফুল ইসলাম আদিবাসী কোটায় প্লট বরাদ্দ এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দাবি যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্বে ছিলেন। এসব কাগজপত্রের ভিত্তিতে ২০০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর ষষ্ঠ বোর্ড সভায় পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের আদিবাসী কোটায় ৩ কাঠার প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপর ২০০৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পূর্বাচল প্রকল্পের ৫ নম্বর সেক্টরের ৩১৫ নম্বর সড়কের ১ নম্বর প্লটটি চূড়ান্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই প্লটটি জাহানারা বেগম বিক্রি করে দেন। দুদকের তদন্তে দেখা গেছে, জাহানারা উন্নয়ন কাজে ক্ষতিগ্রস্ত হননি। তিনি সংশ্লিষ্ট জমির মালিকই ছিলেন না।

দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, জাহানারা বেগমের নামে জাল কাগজপত্র সৃষ্টি করে প্লট বরাদ্দ নিতে সহায়তা করেন রাজউকের পূর্বাচল সেলের তৎকালীন উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এলএ শাখার সাবেক সার্ভেয়ার ইউসুফ ফারুক, এসএম হাবিবুর রহমান, রাজউকের সাবেক উপপরিচালক এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সাইফুল আলম, রূপগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মো. সাহাবুদ্দিন ভূঞা। জালিয়াতি করে প্লট নেওয়ার অভিযোগে ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। দুদকের উপপরিচালক বাদী হয়ে মামলাটি করেন। তবে প্লট জালিয়াতির মূলহোতা আব্দুল জলিল হলেও তাকে আসামি করা হয়নি। কারণ নথিপত্রে তার কোনো স্বাক্ষর ছিল না। এখন মামলার তদন্ত চলছে। তদন্তে তিনিসহ অন্য কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাদের চার্জশিটে আসামি করা হবে।

এদিকে, চাকরি করার সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আব্দুল জলিল ও তার স্ত্রী জাহানারার বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর মামলা করে দুদক। সংস্থাটির উপপরিচালক মো. হাফিজুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় তাদের বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপনসহ মোট ১ কোটি ৬৮ লাখ ১২ হাজার ৪০২ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়।

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com