কমলা বুক ডিপো’র ওমর খৈয়াম

কমলা বুক ডিপো’র ওমর খৈয়াম

ইচ্ছা করেই ‘‘কমলা বুক ডিপো’র ওমর খৈয়াম” হেডিং দিলাম। কেননা, ওমর খৈয়ামের বাংলাতেই এতগুলো সংস্করণ বেরিয়েছে বিভিন্ন বইয়ের ‘ডিপো’ থেকে যে, ক্রেতাদের চোখে ধাঁধা লাগা কিছু বিচিত্র নয়। অবশ্য, সচিত্র ওমর খৈয়াম আপাতত বাজারে দু’খানা-একখানা গুরুদাস লাইব্রেরির এবং আর একখানা কমলা বুক ডিপোর। আরও একখানা প্রেসের গর্ভে কবি-ঔপন্যাসিক হেমেন্দ্রকুমার রায়ের অনুবাদ।

কান্তি বাবুর অনুবাদ ন’দশ বছর হলো বাজারে বেরিয়েছে এবং যথেষ্ট বিক্রিও হয়েছে। তখন বেরিয়েছিল বুক পকেটে রাখতে পারার সাইজে, এখন বেরিয়েছে বোঁচকায় বাঁধা যায় না—এত বৃহৎ হয়ে। সেদিনকার নিরাভরণা শীর্ণা বধূ বেশভূষা-অলংকারে একেবারে রাজরানীর মহিমা ও ঐশ্বর্য নিয়ে দেখা দিয়েছ। সেদিন যাকে নিশ্চিন্তে বুকের কাছটিতে রাখা যেত, আজ তার আসন দরবারের সোনার সিংহাসনে, কাচ-মহলার রাঙা রূপাধারে।

কান্তি বাবুর অনুবাদ যে এত বেশি জনপ্রিয় হয়েছে, তার একমাত্র কারণ তার অনুবাদের সাবলীল ফেনিলোচ্ছল গতি। বাংলায় ওমর খৈয়ামের যতগুলো অনুবাদ বেরিয়েছে কবিতায় বা পদ্যে, তার প্রায় সবই সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে ওমর খৈয়ামের মূল ফার্সি রুবাইয়াৎও পড়েছি। মূল রুবাইয়াতের অনুবাদ তো নয়ই, ওর কাছ দিয়েও যায়নি বাঙলার কোনো ‘ওমর খৈয়াম’। তারা অনুবাদ করেছেন ‘ফিটজেরাল্ড’ ‘হুইনফিল্ড’ বা ওইরকম দু-চারজন অনুবাদককে। তার ফলে এই দাঁড়িয়েছে যে, ওমর খৈয়ামের সুরটুকুর শুধু হয়তো আমরা আভাস পাই, কিন্তু তার অপূর্ব উপমা ছন্দ ও সবচেয়ে বেশি ‘স্টাইলের’ আভাস পাইনে। ওমর খৈয়ামের কবিতা অপূর্ব, কিন্তু যারাই অরিজিনাল খৈয়ামী রুবাইয়াৎ পড়েছেন, তারাই বলবেন, তার প্রকাশভঙ্গি বা স্টাইল আরও আরও অপূর্ব।

অবশ্য স্টাইলের মর্যাদা ক্ষুণ্ন না করে কাব্য অনুবাদ করা হয়তো অতিমাত্রায় দুরূহ, তবু এর খানিকটা আভাস পাওযা যেত, যদি কোনো ফারসি নবিশ কবি এর অনুবাদ করতেন।

তবু এ কথা জোর করেই বলতে পারি, কান্তি বাবুর অনুবাদ ছাড়া বাংলায় আর কারোরই অনুবাদে একাধারে ওমর খৈয়ামের সুর ও প্রাণ দর্শন স্বচ্ছন্দতা এত অধিক পরিমাণে অভিব্যক্তি লাভ করতে পারেনি। আর যারা অনুবাদ করেছেন, কান্তিচন্দ্র তাদের চেয়ে বড় কবি কি না—সে প্রশ্ন তুলব না। কিন্তু এই অনুবাদে কান্তিচন্দ্র তার সহপন্থি সবার শক্তিকে অনেক বেশি অতিক্রম করে গেছেন। শুধু কবির অ্যালবাম কেনা ছাড়া যারা ওমর খৈয়ামের কাব্য দর্শন ও সুরের সঙ্গে পরিচিত হতে চান, তাদের নিঃসংকোচে কান্তি বাবুর অনুবাদ পড়ে দেখার জন্য অনুরোধ করি। এ কথা আমি সমালোচক হিসেবে বলছি না। মূল ওমর খৈয়াম পড়েছি বলেই বলছি।

ফিটজেরাল্ড খৈয়ামের সব রুবাইয়াৎ অনুবাদ করেননি, কান্তি বাবুও ফিটজেরাল্ডের সব কবিতা অনুবাদ করেননি। কিন্তু তাতে আর যে ক্ষতিই হোক—ভাবের দিক দিয়ে কোনো ক্ষতি হয়নি।

অঙ্গসৌষ্ঠবের দিক দিয়েও এর নতুনত্বের জন্য কমলা বুক ডিপোকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারি না। গুরুদাস লাইব্রেরির প্রকাশিত ওমর খৈয়ামের ছবির অ্যালবাম সবচেয়ে চোখকে পীড়া দিয়েছে কবির শ্বেত-শশ্রু-বিমন্ডিত বৃদ্ধ মোল্লা প্রতিমূর্তি। শিল্পী হয়তো বলবেন, ওমর যখন ও কবিতা লেখেন, তখন তিনি ছিলেন বৃদ্ধ। কিন্তু তা যদি সত্যিই হয়, তাহলেও শিল্পী অত রিয়ালিস্টিক হবেন কেন? যে কবি যৌবনের গান রচনা করেন, শারাবের আর সাকীর গালের ডাঁশা ডালিম-দানা রঙে যার কাব্য রঙিন, সেই দুঃখজয়ী তারুণ্যকে কেন যে জরার বহিরাবরণ দিয়ে বিদ্রুপ করা হয়, শিল্পীরাই বলতে পারেন! তরুণীকে বৃদ্ধ প্রেম নিবেদন করছে—এ ছবিতে দেখলেও অসহ্য বোধ হয়।

কমলা বুক ডিপোর ওমর খৈয়াম এই চক্ষুপীড়ার দায় থেকে রেহাই দিয়েছে। এর অধিকাংশ ছবিই মনীষীদের আঁকা। তার মনীষাকে নমস্কার করি। এর ছবিগুলো সত্যিই তার অপূর্ব মনীষার পরিচয়। এর ন্যাজা এবং মুড়োর ছবিগুলোও চমৎকার। এক কথায়, রূপে রঙে সৌন্দর্যে চিত্রে পরিকল্পনায়—কমলা বুক ডিপোর ওমর খৈয়াম অপরূপ।  

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com