আসিফ
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৪:৩৭ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রাযুক্তিক সভ্যতায় আমাদের আত্মোপলব্ধি!

প্রাযুক্তিক সভ্যতায় আমাদের আত্মোপলব্ধি!

৩১ আগস্ট ২০১২। নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যার ৫ নম্বর ঘাট। সন্ধ্যায় জলের প্রতিফলনে চাঁদের আলো কেমন যেন প্রাচীন আবেশ ছড়াচ্ছে, এমন জোছনায় ভাবতে ইচ্ছে করে ইজিয়ান সাগরের উপকূল। শীতলক্ষ্যাপাড়ে হাজার হাজার মানুষের উৎসবমুখর আনাগোনা। সেদিন ছিল ব্লু মুন : নীল জোছনায় অবগাহন, এক মহাজাগতিক উৎসব। আমাদের ডিসকাশন প্রজেক্টের নদীর বাঁকে বাঁকে আয়োজিত অনুষ্ঠানের একটি পর্ব এটি। উৎসর্গ করা হয়েছিল সদ্যপ্রয়াত চন্দ্র পদার্পণকারী নিল আর্মস্ট্রংকে, যিনি চাঁদে পদার্পণের সময় বলেছিলেন পদক্ষেপটা একজন মানুষের জন্য ছোট; কিন্তু মানবজাতির জন্য বিশাল। আর আমি দেখেছিলাম প্রাচীন কেনিয়ার ওমা নদী থেকে যাত্রা করা সেই পাঁচ বছরের শিশু সভ্যতাটি ৩০ লাখ বছরের অভিযাত্রায় এখন কিশোর, শিশুটির প্রতিনিধিত্বকারী এ মানবজাতি আজ এক প্রাযুক্তিক বয়ঃসন্ধিকালে উপনীত।

শীতলক্ষ্যা ঘাটে একদিকে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে চাঁদে পদার্পণের প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হচ্ছে, পাশেই গানবাজনা, কবিতা আবৃত্তি আর একদিকে চলছে বিজ্ঞান আলোচনা অনুষ্ঠান। আয়োজকরা শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষকে চাঁদ দেখানোর কথা বললেও টেলিস্কোপে আকাশটাই দেখানোর চেষ্টা করছে; আকাশের পর মহাকাশ তার মহাজাগতিক ব্যাপ্তি। কখনো কখনো আগত দর্শক, বিশেষত কিছু শিশু, এমন দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছে, যেন নিজের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এই চন্দ্রালোকিত রাতেও অদ্ভুত সব ভাবনা ঘিরে ধরে। জানতে ইচ্ছে করে শিশুরা আসলে কী দেখছে? ওকে আসলে কী দেখাতে চাচ্ছে, অথবা ওর শৈশবের মানসেই বা কীভাবে তা প্রতিভাত হচ্ছে? জানতে ইচ্ছে করে শিশুটি আসলে কী বলতে চাইছে? বর্তমানের শিশু তো ভবিষ্যতের মানুষ, সেখানে তার কর্মকাণ্ডের ভূমিকা সে কীভাবে রাখবে? কোন সুদূরে তার দৃষ্টি? কিছু কি দেখতে চাইছে বা ভাবছে? অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে কি চিন্তিত হয়ে পড়ছে? নাকি, অনাবিল ভবিষ্যতের সন্ধান করছে?

রাজা, মহারাজা, নেতানেতৃত্ব, উচ্চপদস্থ হওয়া, ক্ষমতা-লোভ এসব কাঠামো থেকে কি একদিন বের হয়ে আসবে পৃথিবী? সবাইকে হারিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, নাকি সবার একজন হয়ে প্রসারমান বিশ্বকে সে উন্মোচন করবে কিংবা বিন্দু আর প্রান্তের একীভূত এক জীব যাপনের দিকে অগ্রসর হতে পারবে?

শিশুটি কি জানত যে ভয়াবহ মহামারির পথে এই পৃথিবী? এখন সে কিশোর। তার মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল একটি বয়ঃসন্ধিকালের, কৈশোরের বয়ঃসন্ধিকাল বা বলা যায় বায়োলজিক্যাল অ্যাডলোসেন্স : কৈশোরে শিশুরা শারীরিকভাবে নতুন এমন কিছু অনুভব করে, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকশিত হয়; তখন সেই কিশোরটি সঠিক নির্দেশনা বা পরিপক্বতা ছাড়া মারাত্মক ভুল করে ফেলার বা বিপর্যয় ঘটিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে, অবশ্য নতুন যে কোনো কিছুর ক্ষেত্রেই কিছুটা এই সম্ভাবনা থাকে। শিশুটির চোখগুলোর দিকে তাকান, কী উৎকণ্ঠা!

আমি একটা প্রতিবেদন পড়েছিলাম, যার মূল কথা ছিল শিশুর কান্নায় বিপর্যয় বা যুদ্ধের আশঙ্কার আভাস। শতাব্দী আরম্ভ হওয়ার আগেই মার্টিন রিজ তার ‘আওয়ার ফাইনাল সেঞ্চুরি’ গ্রন্থে, ডেভিড কোয়েম্যান তার স্পিলওভার (অ্যানিমেল ইনফেকশন অ্যান্ড নেক্সট পেনডামিক ২০১৫) গ্রন্থে আগত এই মহামারির সম্ভাবনার কথা বলেছেন, হিসাব করেই বলেছেন আরও নিশ্চয়ই অনেকে বলেছেন। কিন্তু তাতেও মানবসভ্যতা কোনো প্রস্তুতিই নেয়নি; উন্নয়নের কোনো কাঠামোই তা বলে না, সে উন্নত বা অনুন্নত, যে বিশ্বই হোক।

সত্যিই ভয়াবহ মহামারির পথে আজ এই পৃথিবী। সভ্যতা শিশুটি যে বর্তমানে কিশোর। সে দুটি বিপদের মুখোমুখি। একটি আরেকটিকে যেন ত্বরান্বিত করছে। অথচ তার মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল একটির, কৈশোরের বয়ঃসন্ধিকাল বা বলা যায় বায়োলজিক্যাল অ্যাডলোসেন্স।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে : প্রাযুক্তিক বয়ঃসন্ধিকাল বা টেকনোলজিক্যাল অ্যাডলোসেন্স। একটা হচ্ছে সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা সংস্কৃতি প্রস্তুত হওয়ার অনেক আগেই স্মার্ট ডিভাইস বা অতি প্রাযুক্তিক সুবিধাগুলো মানুষের হাতে চলে যাওয়া, তার ওপর সেটা যদি কিশোরদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈধতা পায়, তা আমাদের কল্পনার চেয়েও মারাত্মক বিপদ নিয়ে হাজির হতে পারে; যার ভয়ে গত শতাব্দী জুড়ে বহু চিন্তাবিদ আহাজারি করে বেড়িয়েছেন : জগদীশ চন্দ্র বসু ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ হওয়ার কথা বলেছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে; কিন্তু মানুষ তো নিজেই প্রকৃতি, তাহলে এই প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠতার মানে কী?

আমার মনে হয়, তারা ইকোলজিক্যাল ভারসাম্যের কথা বলেছিলেন; অবশ্য এখানে প্রাচীন একটি প্রশ্নের অবতারণা করা যেতে পারে; গ্রিক সফিস্ট প্রটোগোরাস বলেছিলেন, প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে যদি বিপরীতধর্মী ভাব বিদ্যমান থাকে, তাহলে বিশ্ব-প্রকৃতিতে মানুষের অবস্থান কোথায়?

আইনস্টাইন বিশ্বমেলা-১৯৩৯ দেখে তার ‘আইডিয়াস অ্যান্ড ওপিনিয়ন’ গ্রন্থের ‘টাইম ক্যাপসুলে বার্তা’ প্রবন্ধে একটি সতর্কবার্তা যুক্ত করেছিলেন প্রাযুক্তিক উন্নতির ব্যাপারে। ঔপন্যাসিক ও বিজ্ঞানী সিপি স্নোর ‌‘দ্য টু কালচার’ (১৯৫৯) বক্তৃতায় এ বিষয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বলতে চাইছিলেন বিজ্ঞান এবং মানবতা মানুষের যে বৌদ্ধিক জীবন উপস্থাপন করে, তা ‘দুটি সংস্কৃতিতে’ বিভক্ত হয়ে পড়েছে, যা সমাজের ইনটিগ্রিটি বা অখণ্ডতাকে নষ্ট করে চলেছে, যা এক ভারসাম্যহীন সভ্যতার সূচনা ঘটাচ্ছে।

আমার কাছে মনে হচ্ছে, শিকারি সময়ের যে একাকিত্ব মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত তাকে আমরা আবার ডেকে আনছি। অথচ আমরা বলে বেড়াচ্ছি, এতসব আয়োজন, প্রাযুক্তিক যোগাযোগব্যবস্থা ইত্যাদি নাকি আমাদের একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য।

স্যামুইলোভিচ স্কলোভস্কি, নিকোলাই কার্দেশেভ হয়ে কার্ল সাগান এই সমস্যাটিকে সেলফ ডেস্ট্রাকটিভ কন্ডিশন বা আত্মধ্বংস হিসেবে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করলেন আর তা হলো প্রাযুক্তিক বয়ঃসন্ধিকাল; ফ্রাংক ড্রেক থেকে ফ্রিম্যান ডাইসন সবাই বললেন, ওই একই কথা। শুধুই ব্যবসার জন্য, শুধুই কে কার থেকে লাভে এগিয়ে থাকবে তার জন্য এই ভারসাম্যহীন প্রাযুক্তিক সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছে–যা মূলত প্রাযুক্তিক আত্মধ্বংস। আর যারা এর উদগাতা, তারা নিজেদের সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলেছে, ভয়ানকভাবে কেন্দ্রীভূত করছে পুঁজি; আবার সেই একই মানুষ জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কথা বলে চলেছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ডিজিটাল টেকনোলজি প্রকৃতিগতভাবে কালেকটিভ পার্টিসিপেশন ও কালেকটিভ নলেজের কথা বলে, অথচ ঘটে চলেছে চরম কেন্দ্রীভবন, কী বৈপরীত্য! সহনশীলতা, নমনীয়তা উধাও হয়ে যাচ্ছে। এগুলো মারাত্মকভাবে সাংস্কৃতিক সংকটের মধ্যে এনে ফেলছে আমাদের, আমরা সাংস্কৃতিক সংঘাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছি।

একটি সভ্যতার সবচেয়ে বিপজ্জনক সময় বা বাঁচা-মরার সন্ধিক্ষণ হচ্ছে এই প্রাযুক্তিক বয়ঃসন্ধিকাল। কার্ল সাগান সেই আশির দশকে ‘এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাকটিকা : হু স্পিক ফর আর্থ’ প্রবন্ধে সমস্যাটিকে আরও নির্দিষ্ট করলেন। ফ্রাংক ড্রেক উদ্ভাবিত ‘ড্রেক সমীকরণ’ ব্যবহার করে একটি হিসাব কষলেন বিজ্ঞানীরা, তাতে বললেন প্রতি শতাব্দীতে ষাট শতাংশ সভ্যতা শুধু এ কারণেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। মানে দাঁড়াচ্ছে যে, ১০০টি পৃথিবীর মতো সভ্যতার মধ্যে ৬০টি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এটাই মারাত্মক আশঙ্কার কথা বা সংখ্যা।

তাহলে আমাদের সিলেবাস শেষ করানোর তাগিদে প্রাযুক্তিক বয়ঃসন্ধিকালের দিকে ঠেলে দিয়ে কী লাভ? শিক্ষার মূল কথা মানুষ না ব্যবসার হাতিয়ার তৈরি? এই শিশুরাই কি হবে অসহনশীল, নির্বিকার, লাভক্ষতি হিসাবসর্বস্ব ভবিষ্যতের মানুষ, ব্যবসার ঘুঁটি? তারা অবয়বগতভাবে মানুষ হলেও তাদের মধ্যে মানবিকতার কোনো চিহ্ন থাকবে না? তাদের গ্রাস করবে অসহনশীলতা, অনমনীয়তা? তাহলে ৩০ লাখ বছর ধরে মানুষের তিল তিল করে উঠে আসা আর মহাবিশ্বে নিজেকে অনুধাবন করার কী হবে?

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হাতি শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে আছাড় মারল কৃষককে

বাবার বাড়ি যাওয়ায় স্ত্রীকে ২৭টি কোপ দিলো স্বামী

সিলেটে ট্রাক-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২

ব্যারিস্টার খোকনের দলীয় পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি 

বাড়ি ফেরা হলো না বাবা-ছেলের

বাংলাদেশের দাবদাহ নিয়ে যা বলছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম

অনুষ্ঠিত হলো বিইউএইচএস -এর প্রথম সমাবর্তন

ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে : ম্যাখোঁ

ছেলেদের দোষে ডুবছেন মাহাথির মোহাম্মদ

হিজাব আইন না মানায় ইরানে ব্যাপক ধরপাকড়

১০

তীব্র তাপপ্রবাহে বৃষ্টি চেয়ে হাজারো মুসল্লির কান্না

১১

মানব পাচারের দায়ে একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

১২

ঝিনাইদহে স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর যাবজ্জীবন

১৩

কারিগরির ফাঁকা সনদ মিলল তোষকের নিচে, গ্রেপ্তার কম্পিউটার অপারেটর

১৪

ঝিনাইদহে বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায়

১৫

ভোট দিলে যে শহরে মিলবে ফ্রি বিয়ার, ট্যাক্সিসহ নানা সুবিধা

১৬

কুমিল্লায় পানিতে ডুবে ৪ শিশুর মৃত্যু

১৭

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ফখরুলের সাক্ষাৎ

১৮

চট্টগ্রামে জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার বাঘা শরীফ

১৯

সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরলেন শিক্ষামন্ত্রী 

২০
*/ ?>
X