সম্প্রতি প্রকাশিত হলো ইকরাম কবীরের গল্পগ্রন্থ ‘খুদে গল্পের বই’। শব্দসংখ্যার দিক দিয়ে ছোট্ট গল্প অনুগল্প নামে বেশ পরিচিত হলেও, এ গল্পকার এ গল্পগুলোকে খুদে গল্প নামে ডাকতে ভালোবাসেন। নিমেষেই কিংবা পথচলতি কম সময়ে পড়ে ফেলা যায়, এমন খুদে গল্পই লিখতে চেয়েছেন লেখক। গল্পের ভাষাও সেই হরহামেশা পাঠেরই অনুগামী—কোনো বক্রতা কিংবা আড়াল নেই বাক্যের, একেবারে সহজ সরল। তাই বলে চমক বৈচিত্র্য ও জাদুকল্পের কমতি নেই মোট ৪৭টি খুদে গল্পের এ বইয়ে। এসব নিয়েই কথাসাহিত্যের আঁতুড়ঘরে এবার বই আলোচনা সরাসরি লেখকের সঙ্গেই। আজব প্রকাশ থেকে প্রকাশিত ১৫২ পৃষ্ঠার ‘খুদে গল্পের বই’ নিয়ে ইকরাম কবীর এবং সঞ্জয় ঘোষের কথোপকথন—
পাঠক যারা সময়ের অভাবে পড়তে পারেন না—গল্পের আকার ছোট করলেই তারা পড়বে বলে কোনো নিশ্চিত তথ্য আছে কি?
কিছু তথ্য পাওয়া যায় পশ্চিমা দেশগুলোতে এবং ভারতের খুদে গল্প লেখকদের বইয়ের ভূমিকায়। যদিও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান সীমিত, তবে তথ্য-প্রমাণ থেকে বোঝা যায় যে, তরুণ পাঠকদের মধ্যে ফ্ল্যাশ ফিকশনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, কারণ তারা ছোট এবং সহজে পড়া যায় এমন কনটেন্ট পছন্দ করেন। ২০২১ সালে ‘দ্য রাইটার্স ওয়ার্কশপ’ পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ৬০ ভাগ উত্তরদাতা অনুগল্পকে এর সহজপাঠ্যতার জন্য পছন্দ করেন। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মতো বাজারে ফ্ল্যাশ ফিকশন সংকলন এবং প্রতিযোগিতাগুলো ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডে ‘ন্যাশনাল ফ্ল্যাশ ফিকশন ডে’ উদযাপিত হয় এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়। ভারতে অনুগল্প লেখা এখন নিয়মিত চর্চা। বাংলাদেশেও খুদে গল্পের প্রকাশনা বাড়ছে পাঠকের চাহিদার কারণে। কিছুদিন আগেও, সাহিত্যপাতার সম্পাদকরা খুদে গল্প গ্রহণ করতে চাইতেন না। এখন তারা এমন গল্প নিয়মিত ছাপছেন।
পাঠকের সংখ্যাকে খণ্ডিত না করে সবাইকে আকৃষ্ট করতে খুদে গল্প লেখকদের কোন কোন বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন? বাংলাদেশের পঠন সংস্কৃতি অনুযায়ী বিষয়টি নিয়ে বলুন।
খুদে গল্প পড়ার আনন্দই হচ্ছে যে, গল্পটাকে আরও তীব্রভাবে উপলব্ধি করা। এ কথা সব বয়সী পাঠকের জন্যই সত্য। খুদে গল্পে গল্প থাকার বিষয়টা সবাইকে আকৃষ্ট করে। গল্প কী? গল্প হচ্ছে একটা কনটেন্টে ঘটনা, চরিত্রগুলো, কনফ্লিক্ট ও টুইস্ট এবং পরিশেষে পাঠককে ভাবানোর মতো একটা ইতি টানা। খুদে গল্প হচ্ছে অল্প কথায় এবং কম সময়ে একটা উপন্যাস, বড় বা ছোটগল্পের স্বাদ দিতে পারা। কাজটা বেশ কঠিন—তিনশ থেকে এক হাজার শব্দের মধ্যে একটা উপন্যাস লিখে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তবে শিল্পটা একবার রপ্ত করতে পারলে, লেখকের মন থেকে গল-গল করে গল্প বেরোবে।
বাংলাদেশের মানুষ এক অসহায় জনগোষ্ঠী। তারাই গল্পের পাঠক এবং তারা তাদের জীবনমুখী গল্প পড়তেই ভালোবাসেন, গল্পের ভেতর নিজেকে দেখতে চান। আর বাংলাদেশের পরতে পরতে গল্প ছড়িয়ে আছে। যদি সেই গল্পগুলোকে ধারণ করে বলে ফেলা যায়, তাহলে একজন খুদে গল্পকার অনেকদূর যেতে পারবেন।
আপনার বইয়ের প্রথম গল্প ‘প্রতিশোধ’-এ টিংকুদের যে ভাতের যুদ্ধ—এ সম্পর্কে কিছু বলুন, সেই যুদ্ধটা কেমন? আর ভবিষ্যৎ থেকে টাকা ধার করে জীবন চালানোর ব্যাপারটাই-বা কী?
‘প্রতিশোধ’ গল্পটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক জটিল চিত্রায়ণ; অনেক কিছু বলা হয়েছে এই গল্পে। প্রতিটি মুক্তির সংগ্রাম ও গণআন্দোলনের মূলে থাকে মানুষ। আর মানুষের যুদ্ধটাই হচ্ছে ভাতের। কিন্তু দেখা যায় যুদ্ধ বা বিপ্লব শেষে মানুষের, বিশেষ করে প্রান্তিকজনের ভাতের সমস্যার কোনো সমাধান হয় না। গরিবের ভাতের আকাঙ্ক্ষা চিরকাল চলতে থাকে, কারণ ধনীরা গরিবদের চিরকাল বঞ্চিত রাখে। আর ভবিষ্যৎ থেকে টাকা ধার নেওয়ার মাধ্যমে আমাদের ক্রেডিট কার্ডনির্ভর আধুনিক জীবনকে বুঝিয়েছি। আমাদের জীবন এখন দায়-দেনায় জর্জরিত এবং এ জীবন আমরা না বুঝে পছন্দ করে ফেলেছি, সেটাই বেশি কষ্টের।
একটি গল্পে রাষ্ট্রের ‘সুখ মন্ত্রণালয়’ মানুষের বাড়িতে গিয়ে সুখের ট্যাবলেট বিলি করে। আবার সুখের ট্যাবলেট বাধ্যতামূলক করা হলে একদিন দুঃখের জন্যই আবার স্লোগান ওঠে। সুখ-দুঃখের ভারসাম্যটা আপনার কাছে কেমন?
এটা একটা অরওয়েলিয়ান গল্প। রাষ্ট্র আমাদের জীবনের সবকিছু স্থির করে দিতে চাচ্ছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যারা যায়, তারা সবসময় মানুষের সুখী চেহারা প্রচার করে অনেক বছর ক্ষমতায় থাকতে চায়। কিন্তু আমাদের জীবন তো সুখ-দুঃখের একটা মিশ্রণ। এ মিশ্রণের সঠিক প্রণয়নটা আমাদেরই করতে দিতে হবে। কেউ যদি কিছু আরোপ করতে চায়, সেই পরিস্থিতিতে তার উল্টো করাটাকেই আমরা স্বাধীনতা মনে করব। রাষ্ট্র আমাদের সাধারণ জীবনের সুযোগ তৈরি করে দিলে আমরা সেটাকেই স্বাধীনতা মনে করব।
আপনি ‘গল্পে গল্প থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ’ যেমন মানেন, গল্পের ভাষার ক্ষেত্রে আপনার ভাবনা কী? বাংলা চলতি ভাষার সমসাময়িক সাধারণ যে ধরন, কথাসাহিত্যিকের ভাষা তার চেয়ে পৃথক হওয়া কতটা জরুরি বা আদৌ জরুরি কি না এবং সেখানে লেখকের নিজের ভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে ওঠার ভালো-মন্দটা কেমন বলে মনে করেন?
গল্পের কথা আগেই বলেছি। গল্প হচ্ছে একটা স্ফুলিঙ্গ, পড়তে পড়তে কোনো একটা জায়গায় থেমে পাঠক নিজেকে প্রশ্ন করবেন—‘আহ, এটা কী হলো?’
কথাসাহিত্যিকের নিজের কোনো ভাষা মনে হয় থাকে না; মানুষের ভাষাই তার ভাষা। যুগে যুগে তাই হয়েছে। সাহিত্যিকরা মানুষের ভাষায়ই লিখেছেন। লেখক দেখতে দেখতে, গল্প বলতে বলতে, নিজের জানা ও শোনা ভাষায়ই পটু হয়ে ওঠেন, যেখানে কোনো ভালো-মন্দ নেই, শর্ত নেই। লেখকের উচিত লিখে চলা।
আপনার ‘খুদে গল্পের বই’র সাফল্য কামনা করি। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে এ ধারাটি জোরালো হয়ে উঠুক।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। হ্যাঁ, এ ধারা আরও গতি পাবে। খুদে গল্প কোথায় নেই? আফ্রিকা, আমেরিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা—সবখানে লেখা হচ্ছে, বলা হচ্ছে। এখন খুদে সিনেমা, খুদে নাটক, খুদে স্যাটায়ার—সব লেখা হচ্ছে। খুদে গল্প অনেক প্রাচীন একটা ধারা। ইশপের গল্পের কথাই ধরুন। সেগুলো সবই তো খুদে। তার গল্পের তীব্রতা সমাজে অনেক বেশি। এমন গল্প হেমিংওয়ে, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বনফুল সবাই লিখেছেন। ভবিষ্যতে খুদে গল্পের প্রভাব অনেক বেশি হবে।