প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ১২ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:২৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না

নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না

যত উন্নয়ন হবে, দুর্ঘটনার ঝুঁকি তত বাড়বে। তাই বলে তো আর উন্নয়ন থামিয়ে রাখা যাবে না। তবে উন্নয়নটা হতে হবে পরিকল্পিত। উন্নয়নের সঙ্গে দুর্ঘটনা ঠেকাতে নিতে হবে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও ক্ষতি কমাতে নানান আধুনিক ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমরা কোটি টাকা খরচ করে কারখানা স্থাপন করি। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য লাখ টাকা ব্যয় করতে চাই না। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা অনেক হৈচৈ করি। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। সমস্যা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যায়। যেমন বঙ্গবাজারে আগুন লাগার পর আগুন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। কদিন আগে যখন সিদ্দিকবাজার এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল, তখনো তিতাস গ্যাসের লাইনের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। নিমতলী ও চুড়িহাট্টায় আগুনের পর পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের কারখানা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু কি হয়েছে? আমরা নিজেরা এ শহরকে মৃত্যুকূপ বানিয়েছি এবং নিজেরা সেই শহরে বসবাস করছি। গাছের ডালে বসে সেই ডাল কাটছি। আমরা আসলে আত্মহত্যাপ্রবণ জাতি।

দুর্ঘটনা ঘটবেই। আমরা কমানোর চেষ্টা করতে পারি, ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করতে পারি। আমরা জানি সাবধানতা ও সতর্কতাতেই এটা সম্ভব। কিন্তু মুখে বললেও আমরা সতর্ক হই না, সাবধান হই না। আমার বাসা মোহাম্মদপুরের আসাদ অ্যাভিনিউতে। ভবনটিতে দুর্ঘটনা রোধে সব ধরনের ব্যবস্থাই করা আছে। প্রপার ফায়ার এক্সিট আছে। সব ফ্লোরে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আছে, এমনকি ফায়ার হাইড্র্যান্টও আছে। গুলশানে একটি আধুনিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর আমাদের ভবন থেকে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে মহড়ার আয়োজন করা হয়। এক সপ্তাহ আগে থেকেই ভবন কর্তৃপক্ষ সবাইকে মহড়ার সময় জানিয়ে ই-মেইল করে, তারপর দফায় দফায় টেলিফোন করে। বাসার সব সদস্য তো বটেই, এমনকি বাসার সহকারী ও চালকদেরও মহড়ায় উপস্থিত রাখার অনুরোধ করা হয়। আগের দিন জানানো হয়, শুক্রবার সকাল ১০টায় মহড়া হবে। ঠিক ১০টায় গোটা ভবনের ফায়ার অ্যালার্ম বাজিয়ে দেওয়া হয়। মহড়ায় তারা হাতে-কলমে সব ব্যবস্থা দেখিয়ে দেন। কীভাবে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করতে হবে, কীভাবে ফায়ার এক্সিট ব্যবহার করতে হবে, কোথায় পানি আছে, কোথায় ফায়ার হাইড্র্যান্ট আছে—সব তারা দেখিয়ে দেন। মহড়ায় উপস্থিত শিশুটিও আগুন লাগলে প্রাথমিক করণীয়টা ঠিকমতো করতে পারবে। কিন্তু আমাদের ভবনের ২৬টি পরিবারের মধ্যে মহড়ায় উপস্থিত ছিলেন মাত্র তিনটি পরিবারের সদস্যরা। এই আমরাই কিন্তু আগুন লাগলে ভবন কর্তৃপক্ষকে গালি দেব, ফায়ার সার্ভিসের ওপর দায় চাপাব। তাই নিজের বাঁচাতে হলে আগে নিজেকেই সতর্ক হতে হবে, সাবধান থাকতে হবে। দায় চাপিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করা যাবে, বাঁচা যাবে না।

আমরা আসলে ভাগ্যবান। নইলে আমরা যেমন অনিরাপদ শহরে বাস করি, তাতে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটনার কথা। সেই তুলনায় দুর্ঘটনা অনেক কম ঘটে। সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের পর তিতাসের গ্যাসের লাইন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। শুধু সিদ্দিকবাজারের সেই ভবন নয়, ঢাকায় তিতাসের হাজারো অনিরাপদ লাইন আছে। অসংখ্য বোমা তৈরি করে রেখেছি আমরা নিজেরাই। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা বলি, এ ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আমাদের চোখ কিন্তু খোলে না, বন্ধই থাকে। সিদ্দিকবাজারের দুর্ঘটনার পর কি তিতাসের সব ঝুঁকিপূর্ণ লাইন নিরাপদ করা হয়েছে? একটিও হয়নি। আবার যখন গ্যাস জমে বিস্ফোরণ হবে, আমরা আবার অনেক কথা বলব, অনেক সেমিনার করব। কিন্তু আসল কাজটা করব না।

নিমতলী আর চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরানো নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এখনো পুরান ঢাকায় গেলে অসংখ্য অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের গুদাম পাওয়া যাবে। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, নিমতলী আর চুড়িহাট্টার মতো ঘটনা অনেক বছর পরপর ঘটে। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে এ ধরনের দুর্ঘটনার বাস্তবতা আমরাই তৈরি করে রেখেছি।

ঢাকায় সবচেয়ে নিয়মিত দুর্ঘটনা হলো আগুন। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, গ্যাসের চুলা, ফেলে দেওয়া সিগারেট—এমন অনেক ছোট ঘটনা থেকে ঘটতে পারে বড় অগ্নিকাণ্ড। তবে কোনো বস্তি বা মার্কেটে আগুন লাগলে আমার প্রথমেই সন্দেহ হয়, খালি করার জন্য ইচ্ছা করে লাগানো হয়নি তো। আগুন লাগার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটকে। কিন্তু এই শর্টসার্কিটটা কেন হয়, সেটা কি আমরা খতিয়ে দেখেছি কখনো। আপনি টাকা বাঁচাতে নিম্নমানের তার লাগাবেন। নির্ধারিত লোডের চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, আপনার কমদামি তার সেটা সইবে কেন? ফলে দায়টা কিন্তু বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের নয়, আমাদের সবার। আমরা যদি বিদ্যুৎ ব্যবহারে সতর্ক হই, ভালো তার লাগাই, ওয়ারিংটা ঠিকমতো লাগাই, লাইন নিয়মিত চেক করি, শর্টসার্কিট হবে না। আমরা সিগারেট ফেলার পর আগুন নেভানোটা নিশ্চিত করি। যদি গ্যাসের চুলাটা ঠিকমতো বন্ধ করি। যদি গ্যাসের লাইনটা নিয়মিত চেক করি। দুর্ঘটনা অবশ্যই কমে আসবে। আমাদের কয়টা বাসায় আগুন নেভানোর প্রাথমিক ব্যবস্থা আছে, যাতে আমরা ফায়ার সার্ভিস আসা পর্যন্ত আগুনের বিস্তার ঠেকিয়ে রাখতে পারি। পারি না। তারপর সব ঝাল মেটাই ফায়ার সার্ভিসের ওপর—তাদের আসতে দেরি হলো কেন, তারা কেন আগুন নেভাতে দেরি করল। ফায়ার সার্ভিসের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, আন্তরিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। আগুনের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ছুটে আসে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জীবনের পরোয়া না করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেকে জীবন দেয়। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের আসার মতো প্রশস্ত রাস্তাই রাখি না আমরা। আসার পর তারা আগুন কী দিয়ে নেভাবে? আগুন নেভাতে পানি তো লাগবে। সেই পানির ব্যবস্থা কি আমরা রেখেছি। বঙ্গবাজারে আগুন লাগার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের পুকুর থেকে পানি আনতে হয়েছে। হেলিকপ্টার দিয়ে পানি এনেছি রমনা পার্কের লেক আর হাতিরঝিল থেকে। কিন্তু ঢাকায় জালের মতো ছড়িয়ে থাকা খালগুলো কই গেল। একটা আধুনিক নিরাপদ শহরে ১৫ শতাংশ জলাধার থাকার কথা। ঢাকায় আছে ৫ থেকে ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহর থেকে প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজার ৭৫৭ একর জলাভূমি হারিয়ে গেছে। সিএস রেকর্ড অনুযায়ী ঢাকায় একসময় ৫২৩টি পুকুর ছিল। এখন আছে গোটা পঞ্চাশেক। আমরা খাল বন্ধ করে রাস্তা বানাই, জলাধার ভরাট করে উঁচু উঁচু ভবন বানাই। আর ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে দেরি করলে তাদের গাড়ি ভাঙচুর করি। বড় অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার হাইড্র্যান্ট নিয়ে অনেক কথা হয়। কিন্তু গত ৫০ বছরে আমরা কয়টা ফায়ার হাইড্র্যান্ট লাগিয়েছি?

আরও বড় কোনো বিপর্যয় থেকে বাঁচতে হলে আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে। পর্যাপ্ত জলাধার নিশ্চিত করতে হবে। ভবন বা মার্কেট যাই বানাই না কেন, তাতে আগুন নেভানোর প্রাথমিক ব্যবস্থা রাখতে হবে। দুর্ঘটনা হলে মানুষের বের হওয়ার পথ রাখতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার পথ রাখতে হবে। নিজের হাতে গ্যাসের চুলাটা বন্ধ করতে হবে। বিদ্যুতের লাইন পরীক্ষা করতে হবে। তিতাসের অবৈধ লাইন বিচ্ছিন্ন করতে হবে। রাসায়নিকের গুদাম নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে হবে।

সতর্ক থাকলেই যে দুর্ঘটনা ঘটবে না, সেটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাবে না। তবে আমরা যদি সবাই নিজ নিজ জায়গায় সতর্ক থাকি। সরকার যদি তার দায়িত্বটা ঠিকমতো পালন করে, তাহলে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। আর তখন দুর্ঘটনা ঘটলেও ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। কিন্তু সব পুকুর ভরাট করে ভবন বানালে আগুনের ভয়াবহতা কমবে না। বরং প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবে। এখন নিরাপদ ভবনে বসে ফায়ার সার্ভিস আর সরকারকে গালি দিয়ে আমরা বাঁচতে পারব না। নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পাবে না। আমার ভবনটি না হয় নিরাপদ। পাশের ভবনটি নিরাপদ না হলে কিন্তু আমিও বাঁচব না। বঙ্গবাজারের আগুনের উত্তাপ কিন্তু ছুঁয়ে গেছে পুলিশ সদর দপ্তরকেও। তাই নিরাপদ থাকতে হবে সবাই মিলে।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ব্যাংককে নেওয়া হলো বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুকে

বৃষ্টির জন্য রাজশাহীতে অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা

বিএনপির আরেক নেতা বহিষ্কার

নদীতে মিলল ছাত্রলীগ নেতার পচাগলা মরদেহ

আমেরিকার কত ট্যাঙ্ক অক্ষত আছে ইউক্রেনে?

অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রাণ-আরএফএল গ্রুপে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ

এমপি একরামুলকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জেলা আ.লীগের

সরকার মিথ্যা উন্নয়নের বেসুরো বাঁশি বাজাচ্ছে : এবি পার্টি

যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সামাজিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন

রাজনীতিতে দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে আ.লীগ : ইসলামী আন্দোলন

১০

ব্রিজের মুখ বন্ধ / হাজার বিঘা জমির পানি নিষ্কাষণে শঙ্কা

১১

ব্যাংক একীভূতকরণ দায়মুক্তির নতুন মুখোশ : টিআইবি

১২

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলো

১৩

যুব মহিলা লীগ নেত্রীর বাসা থেকে অপহৃত কিশোরী উদ্ধার

১৪

‘পাকিস্তানের নিরাপত্তাকে নিজের মনে করে ইরান’

১৫

পথ-প্রান্তর রাঙিয়ে তুলেছে রক্তরাঙা কৃষ্ণচূড়া

১৬

এসএসসি পাসে মীনা বাজারে চাকরি, আবেদনের বয়স ১৮

১৭

জমি জরিপ নিয়ে নতুন নির্দেশনা ভূমিমন্ত্রীর

১৮

ছাত্রলীগ নেতা লুটে নিচ্ছেন গোমতী নদীর মাটি

১৯

সৌদি আরবে চলচ্চিত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন কে এই হানা আল-ওমাইর

২০
*/ ?>
X