নারী-পুরুষের সমতা সমৃদ্ধ জাতি গঠন করে

নারী-পুরুষের সমতা সমৃদ্ধ জাতি গঠন করে

দেশে বিরামহীন, অবর্ণনীয় নারী নির্যাতন, নিপীড়নের চিত্র জাতিকে হতাশ করে। পারিবারিক নারী নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন শেষে হত্যা, পেটের দায়ে কাজ করতে আসা শিশু গৃহকর্মীর ওপর অমানুষিক নির্যাতন, যৌতুকের বলি হয়ে নারীর অব্যাহত আত্মহত্যার মতো নারীর প্রতি বহুমাত্রিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। তারপরও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ যা কোনোমতে একটি সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত হতে পারে না। শুধু কম্পিউটার লিটারেসি, আইসিটির প্রসার, মোবাইল ফোনের ছড়াছড়িই কি শিক্ষা বিকাশের মাপকাঠি হতে পারে? কী অর্জন দিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি একটি সুন্দর, সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের।

একটি ধর্ষণের ঘটনায় শুধু ধর্ষিতাই যে আক্রান্ত হয় তা কিন্তু নয়। এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে গোটা নারীসমাজে। বিশেষ করে উঠতি বয়সের মেয়েদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়গামী তরুণীরা শঙ্কায় থাকেন কখন তাদের কেউ এমন এক অভিশপ্ত ঘটনার নির্মম শিকার হবেন। লোকলজ্জার ভয়ে হয়তোবা গোপন রাখা হয় অনেক নির্মম ঘটনার কথা। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার। ফতোয়া, পাচার, যৌতুক, ধর্ষণ ও অ্যাসিড সন্ত্রাসের নির্মম বলি হচ্ছেন দেশের অসংখ্য নারী। শুধু কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ার অপরাধে নারীকে স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত হতে হয়েছে। প্রেমের নামে প্রতারণা ও ধর্ষণের অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করছে স্কুল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। আদরের সন্তানসহ নিজে ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহুতি দিয়েছে মা। দেশের অসংখ্য নারী তাদের স্বামী বা স্বজনের কাছে প্রতারিত হয়ে জীবনের চরম নৈরাশ্য ও বৈরিতার মুখোমুখি হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের অতল গহ্বরে। যৌতুকলোভী স্বামীর অত্যাচার নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে রাগ, ক্ষোভ ও অভিমানে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মাহুতি দিচ্ছে।

অতীতে নাজমুন নাহার, সিমি, বুশরা, সিমি, ইন্দ্রানী, মহিমা, তৃষা ও ফাহিমার মতো বহু কিশোরী সমাজের বখাটের নির্যাতন-নিপীড়নের দুঃখ, অপমান আর জ্বালা সইতে না পেরে আত্মহননে বাধ্য হয়েছে। এক পরিসংখ্যানমতে, শারীরিক নির্যাতনের হার ৬৪%, মানসিক নির্যাতন ৮১%, পারিবারিক নির্যাতন শতকরা ৮৭ ভাগ। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০২০-২১ সালে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৪ হাজার ৫৬৭ নারী। ২০১৯-২০ সালে এ ধরনের শিকার নারীর এ সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৬৬০, ২০১৮-১৯ সালে ছিল ১১ হাজার ৫৬৯ এবং ২০১৭-১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৬৫৬ জন। একই সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে যথাক্রমে ৭২২২, ৫৮৪২, ৪৭১৭, ৩৯৫৫ নারী। ২০১৯ সালে মোট ধর্ষিতা নারীর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ১০ জন। এ বছর ২৫৮ নারী যৌন হয়রানির ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ৪৪ পুরুষ। উত্ত্যক্তের কারণে ১৮ নারী আত্মহত্যা করেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৪ নারীসহ ১৭ জন খুন হয়েছেন। একই বছরে শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ ও নিখোঁজের পর ৪৮৭টি শিশু নিহত হয়েছে। ধর্ষণ ছাড়াও বর্তমানে সংঘটিত হচ্ছে বহুমাত্রিক নারী নির্যাতন। নারীর শিক্ষার প্রসার ঘটলেও প্রকৃত সংস্কারমুক্ত হতে পারেনি পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজের মানুষ।

নারীর পোশাক বা পুরুষের কামপ্রবৃত্তির উন্মাদনা ধর্ষণের মূল কারণ হতে পারে না। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে নারীকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করতে না পারার মানসিকতা পুরুষের মাঝে যে মিথ্যে শ্রেষ্ঠত্ববোধের জন্ম দেয়, তা থেকে মূলত তাদের ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের পথে ঠেলে দেয়। অর্থবিত্ত ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা বা তাদের মদতপুষ্টরাই বেশিরভাগ ধর্ষণের মতো ঘৃণিত অপরাধ করে থাকে। তারা ভাবে, তাদের ক্ষমতার দাপটের কাছে আইন বা ন্যায়নীতির বাঁধন কোনো কিছু করতে পারবে না। বাস্তবেও দেখা যায়, অর্থ ও ক্ষমতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ প্রভাবশালীদের মামলা নিতেও গড়িমসি করে। আবার মামলা নিলেও তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে টালবাহানা করা হয়। কখনো টাকার বিনিময়ে অপরাধীদের বাঁচিয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার নজিরও বিরল নয়। পুরুষতান্ত্রিত সমাজ কাঠামোয় নারীর প্রতি অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে ধর্ষণের অভিযোগ বিচারহীনতায় শেষ হয়। আর বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি ধর্ষকদের উৎসাহিত এবং বেপরোয়া করে তোলে। মামলার দীর্ঘসূত্রতাও ধর্ষণকে উৎসাহিত করে। রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় নারীরা সাধারণত লোকলজ্জা ও সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে ধর্ষণের কথা প্রকাশ করে না। সত্যিকার অর্থে নারী-পুরুষের স্বীকৃত সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা পায়নি আজও। সমাজ কাঠামোও নারীস্বার্থের বিপরীতে অবস্থান নেয়। তাই অপরাধী অতি সহজে পার পেয়ে যায়। তাই নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে পারে। আর যেহেতু পুরুষ দ্বারাই নারী বেশি নির্যাতিত হয়, সেহেতু নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুরুষকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। বদলাতে হবে নারীর প্রতি পুরুষের আধিপত্যবাদী মানসিকতার।

আজকের এক নারীশিশু আগামী দিনে পূর্ণবয়স্ক নারীতে রূপ নিয়ে দেশ ও সমাজে গঠনে পুরুষের পাশাপাশি ভূমিকা রাখবে। বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষায়, কর্মক্ষেত্রে নারীর সাফল্য গর্ব করার মতো। প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। এদের অনেকেই নিয়োজিত হচ্ছে দেশ-বিদেশের নানা কর্মকাণ্ডে। কেউ কেউ বহাল হচ্ছে রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্বপূর্ণ পদে। পহেলা বৈশাখে বা একুশের প্রভাত মিছিলে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ আয়োজনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ অসাম্প্রদায়িক উৎসবে-আয়োজনে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কোটি নারী-পুরুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে মুগ্ধ করে। আজ গ্রাম-শহরের লাখো ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে রাখছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।

আসকের তথ্যানুসারে, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের শিকার হলেও এর বিপরীতে মামলা হয়েছে ৯৯৯টি। মামলার তথ্য রয়েছে ৪১৪টির। ধর্ষণের সময় সাধারণত কোনো প্রত্যক্ষদর্শী থাকে না। ধর্ষণ প্রমাণে সবসময় সাক্ষী পাওয়াও যায় না। লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষিতার পক্ষ থেকে মামলায় অনীহা প্রকাশ করা হয়। তবে ধর্ষক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার অপরাধের কথা স্বীকার করে। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন ও নারী কর্মকর্তা দিয়ে মামলা তদন্ত এবং বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা সর্বোপরি দ্রুত সময়ে কৃতকর্মের শাস্তিরও ব্যবস্থা হয়েছে। কখনো ধর্ষক হয় ছন্নছাড়া, নেশাগ্রস্ত, জীবনের সব সুবিধাবঞ্চিত। সমাজের ভদ্র লেবাসধারী যেসব অমানুষ একের পর এক ধর্ষণ, নারী নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের স্বরূপ উন্মোচিত করতে হবে। তাদের ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করুন। যথাসময়ে এসব ভদ্রবেশী ধর্ষকের বিচারকাজ সমাধা হচ্ছে কি না দেখতে হবে। তাদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হতে হবে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে, ধর্ষকের শাস্তির দাবিতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ। কেননা একজন ধর্ষকের বিচার করে শাস্তি দিয়ে সমাজ থেকে ধর্ষণ উচ্ছেদ করা যাবে না। ধর্ষকদের প্রাণদণ্ড দিয়েও না।

নারীর প্রতি সব ধরনের অমানবিক আচরণ প্রতিরোধে প্রতিটি সচেতন মানুষ, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে দায় নিতে হবে। আর সবচেয়ে বেশি জরুরি দেশের মানুষের নৈতিকতার উত্থান ও পাশবিকতার দমন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিকাশ, আকাশ সংস্কৃতির প্রসার মানুষের মনোজগতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, এ থেকে বেরিয়ে এসে মানবিক চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটাতে না পারলে লোকচক্ষুর আড়ালে নারী নির্যাতন চলতেই থাকবে। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান, বৈষম্যহীন ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে ধর্ষণসহ নানাবিধ নারী নির্যাতন প্রতিরোধসহ নারীর সামনে এগিয়ে চলার পথ অবারিত হতে পারে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর সামনে এগিয়ে চলাই তো দেশের এগিয়ে চলা।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com