শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
মাওলানা মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৩, ১০:১৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মন্দা মোকাবিলায় ইসলামের শিক্ষা

মন্দা মোকাবিলায় ইসলামের শিক্ষা

পৃথিবীতে বর্তমান সময়টা খুব ভালো যাচ্ছে না। করোনা মহামারি, যুদ্ধ-সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড একের পর এক আঘাত হানছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। যার প্রভাব পড়ছে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। আর নানামুখী অস্থিরতার প্রথম ধাক্কায় আক্রান্ত হচ্ছে বিশ্বের অর্থনীতি। এ বছর বিশ্ব অর্থনীতি খারাপ সময় পার করবে এমন পূর্বাভাস আগেই দিয়েছিল বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা; কিন্তু সংকট কতটা গভীর হবে সেটা নিয়েই উদ্বেগ ছিল সবার। কারণ পুরো বিশ্বের অর্থনীতি ভয়াবহ মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের মন্দার ধাক্কা উন্নয়নশীল বিশ্বেও পড়ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, নতুন বছরেই মন্দার কবলে পড়বে বিশ্বের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ দেশ। যার প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বে। যেসব দেশ মন্দার কবলে পড়বে না, সেসব দেশের সাধারণ মানুষও এর ধাক্কা অনুভব করবে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে আমাদের দেশেও। দুশ্চিন্তা বেড়েছে ক্ষুদ্র আয়ের মানুষ থেকে শীর্ষ ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা পর্যায়েও। দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতায় দিন কাটাচ্ছে মানুষ। সময় এসেছে ইসলামের আলোকে মন্দা মোকাবিলা শিক্ষা ও প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করার। কারণ, মানুষের ভেতরের স্বভাবজাত ধর্মানুভূতি ধর্মের আলোকে সংকট থেকে উত্তরণের পথ খোঁজে।

আমরা জানি প্রাচীন মিশরে নবী ইউসুফ (আ.) কারারুদ্ধ অবস্থায় সেখানকার বাদশা একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন। পবিত্র কোরআনে বিস্তারিতভাবে সে বিবরণ স্থান পেয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বাদশাহ বলল, আমি স্বপ্নে দেখলাম, সাতটি মোটাতাজা গাভি—এদের সাতটি শীর্ণ গাভি খেয়ে যাচ্ছে এবং সাতটি সবুজ শিষ ও অন্যগুলো শুষ্ক।’ (সুরা ইউসুফ : ৪৩)। এরপর তিনি এর ব্যাখ্যার জন্য কারারুদ্ধ নবী ইউসুফের (আ.) কাছে গেলেন এবং তার কাছে এর সঠিক ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। ইউসুফ (আ.) আসন্ন মন্দা ও দুর্ভিক্ষের কথা জানালেন। মন্দা ও দুর্ভিক্ষকালে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ধস এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় বলে দিলেন। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সচল রাখতে ভবিষ্যৎ বাজেট পরিকল্পনার নকশাও করে দিলেন। পবিত্র কোরআনের ভাষ্য, ‘ইউসুফ স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বললেন, তোমরা সাত বছর উত্তমরূপে চাষাবাদ করবে। অতঃপর যা কাটবে, তার মধ্যে যে সামান্য পরিমাণ তোমরা খাবে তা ছাড়া অবশিষ্ট শস্য শিষসমেত রেখে দেবে। এবং এরপর আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর; তোমরা এ দিনের জন্য যা রেখেছিলে, তা খেয়ে যাবে; কিন্তু অল্প পরিমাণ ব্যতীত, যা তোমরা তুলে রাখবে। এর পরই আসবে এক বছর—তখন মানুষের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং তখন তারা রস নিংড়াবে।’ (সুরা ইউসুফ : ৪৭-৪৯)

আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নবী ইউসুফ (আ.) এখানে চৌদ্দ বছরের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন এবং আসন্ন দুর্যোগ ও সংকট মোকাবিলায় দেশের উৎপাদন এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব করে দিয়েছেন। ইউসুফ (আ.)-এর আল্লাহপ্রদত্ত এই অভূতপূর্ব পরামর্শে বিমোহিত হয়ে বাদশা তাকে নিজের একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব করলেন। কোরআনের ভাষ্য, ‘বাদশাহ বলল, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে নিজের বিশ্বস্ত সহচর করে রাখব।’ (সুরা ইউসুফ : ৫৪); কিন্তু ইউসুফ (আ.) এ প্রস্তাব শুনে নিজের পক্ষ থেকে একটি আবেদন করলেন। কোরআনের ভাষ্য, ‘ইউসুফ বলল, আমাকে দেশের ধন-ভান্ডারে নিযুক্ত করুন।’ (সুরা ইউসুফ : ৫৫)। নবী ইউসুফ (আ.) কেন অর্থমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পেশ করেছিলেন? এর কারণও তিনি বর্ণনা করেছিলেন— ‘আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও অধিক জ্ঞানবান।’ (সুরা ইউসুফ : ৫৫)।

এ থেকে আমরা আয় ও ব্যয়ে ভারসাম্য স্থাপনের শিক্ষা পাই। চাই সেটা ব্যক্তিগত হোক, পারিবারিক হোক কিংবা রাষ্ট্রীয়। এ কথাটি আরবিতে ব্যক্ত করা হয় ‘ইকতিসাদ’ শব্দে, যার অর্থ মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। এ নামকরণ থেকেই আয়-ব্যয় ও জমা-খরচ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়। বর্তমান দুর্যোগপূর্ণ অস্থির সময়ে আমাদের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনাও যেন আল্লাহতায়ালার হুকুম ও রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুযায়ী হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা কর্তব্য।

কোরআন-হাদিসের বিস্তৃত আলোচনায় মন্দা মোকাবিলার আরও অনেক কর্মমুখী পদক্ষেপের কথা এসেছে। জানানো হয়েছে, মানুষের পাপের কারণেই পৃথিবীতে আজাব-গজব, মন্দা-দুর্ভিক্ষ ও সমস্যা-সংকট সৃষ্টি হয়। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে—‘তোমাদের ওপর যেসব বিপদাপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল। তিনি তোমাদের অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (সুরা শুরা : ৩০)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। যাতে তিনি তাদের কৃতকর্মের কিছু শাস্তি আস্বাদন করান। যার ফলে তারা ফিরে আসবে।’ (সুরা রোম : ৪১)। ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে মুহাজিররা! পাঁচটি কারণে পাঁচ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়—১. কোনো সমাজে প্রকাশ্যে পাপাচার হলে সেখানে এমন রোগ-ব্যাধি প্রকাশ পায়, যা তাদের পূর্বসূরিদের মধ্যে ছিল না। ২. যখন কোনো সম্প্রদায়ের শাসকরা আল্লাহর কিতাবের শাসন থেকে বিরত থাকে, তখন তাদের নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধ ও সংকট সৃষ্টি হয়। ৩. যখন কোনো সম্প্রদায় জাকাত আদায় করা থেকে বিরত থাকে, তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ হয়ে যায়। চতুষ্পদ জন্তু না থাকলে আসমান থেকে মোটেই বৃষ্টি হতো না। ৪. যখন কোনো সম্প্রদায় ওজনে কম দেয়, তখন তাদের মধ্যে দুর্ভিক্ষ ও সংকট সৃষ্টি হয়। ৫. যখন কোনো সম্প্রদায় আল্লাহ ও রাসুলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন তাদের ওপর তাদের শত্রুদের চাপিয়ে দেওয়া হয়। ফলে তাদের অনেক সম্পদ তারা ছিনিয়ে নেয়। (ইবনে মাজা : ৪০১৯)। এ জন্য আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব ধরনের পাপ বর্জন করা।

মানুষ তো পাপপ্রবণ। পাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। পাপ হয়েছে, খাঁটি অন্তরে তাওবা করতে হবে। তাওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমে বিপদ-মুসিবত দূর হয়ে যায়। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে—‘আর আল্লাহ এমন নন যে, তারা ইস্তেগফার করবে অথচ তিনি তাদের আজাব-গজব দেবেন।’ (সুরা আনফাল : ৩৩)। হাদিস শরিফে নবীজী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে, তাকে আল্লাহতায়ালা দুটি জিনিস দান করবেন—১. যাবতীয় দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি থেকে মুক্তি দেবেন। ২. অকল্পনীয় জায়গা থেকে তাকে রিজিক দেবেন।’ (আবু দাউদ-১৫১৮)

মন্দা মোকাবিলায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে সামাজিক বন্ধন মজবুত করা। মুসলিম সমাজে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সবসময়ই মজবুত থাকবে। তবে সংকটকালীন সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে সংকট মোকাবিলা করলে সহজ হবে। নবীজীর আমল থেকেও আমরা এ বিষয়ে ধারণা পাই। হিজরতের পর মদিনায় মুহাজির সাহাবিদের সংকট নিরসনে নবীজী আনসার সাহাবিদের সঙ্গে তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে দেন। তখন আনসারি সাহাবিরা সর্বাত্মক সহযোগিতার মাধ্যমে মুহাজিরদের সংকট লাঘবে চেষ্টা করেছেন। আনাস (রা.) বলেন, আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) হিজরত করে মদিনায় আগমন করলেন। তখন নবীজী (সা.) সাদ ইবনে রবি আনসারি (রা.)-এর সঙ্গে তার ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে দেন। (বুখারি : ৩৭২২)। আমাদের সমাজে বিভিন্নভাবে ভ্রাতৃত্বের এই চর্চা থাকলেও নানা কারণে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য আমরা দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারি—১. বেশিরভাগ মানুষই কোনো না কোনো পেশায় নিয়োজিত। তাই প্রতিটি কর্মস্থলের কর্মীরা নিজেদের মধ্যে একটি ইউনিটি গড়ে তুলবে। এখানে নিয়মিত কোনো আর্থিক লেনদেন হবে না। বরং ইউনিটের কোনো সদস্য বিপদগ্রস্ত হলে তাৎক্ষণিক অন্যান্য সদস্য উদ্যোগ নিয়ে তাকে সহযোগিতা করবে। এটিও একটি সুন্নত। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুল (সা.) ঘোষণা করতেন—‘ইমানদারদের কেউ ঋণ রেখে মারা গেলে তা পরিশোধের দায়িত্ব আমার ওপর। আর (ইমানদারদের) কেউ সম্পদ রেখে মারা গেলে, সেই সম্পদ তার ওয়ারিশদের।’ (বুখারি ও মুসলিম)। হাদিসটির বক্তব্য মৃত্যুর সঙ্গে উল্লেখ হলেও আমরা জীবনমৃত্যু সব ক্ষেত্রেই এর শিক্ষা প্রয়োগ করতে পারি। ২. ব্যক্তিপর্যায়ে সহযোগিতা করা। যাদের সামর্থ্য আছে তারা অভাবী মানুষকে দান করবেন। অথবা কর্জে হাসানা তথা সুদমুক্ত ঋণ দিয়েও সংকট মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে পারেন। কর্জে হাসানার ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান করো, তবে তিনি তোমাদের জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী ও ধৈর্যশীল।’ (সুরা তাগাবুন : ১৭)

মহান আল্লাহ সবাইকে আসন্ন বৈশ্বিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষ থেকে হেফাজত করুন এবং তার আশ্রয় লাভের তাওফিক দিন।

লেখক : ইসলামী গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ব্যারিস্টার খোকনের দলীয় পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি 

বাড়ি ফেরা হলো না বাবা-ছেলের

বাংলাদেশের দাবদাহ নিয়ে যা বলছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম

অনুষ্ঠিত হলো বিইউএইচএস -এর প্রথম সমাবর্তন

ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে : ম্যাখোঁ

ছেলেদের দোষে ডুবছেন মাহাথির মোহাম্মদ

হিজাব আইন না মানায় ইরানে ব্যাপক ধরপাকড়

তীব্র তাপপ্রবাহে বৃষ্টি চেয়ে হাজারো মুসল্লির কান্না

মানব পাচারের দায়ে একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

ঝিনাইদহে স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর যাবজ্জীবন

১০

কারিগরির ফাঁকা সনদ মিলল তোষকের নিচে, গ্রেপ্তার কম্পিউটার অপারেটর

১১

ঝিনাইদহে বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায়

১২

ভোট দিলে যে শহরে মিলবে ফ্রি বিয়ার, ট্যাক্সিসহ নানা সুবিধা

১৩

কুমিল্লায় পানিতে ডুবে ৪ শিশুর মৃত্যু

১৪

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ফখরুলের সাক্ষাৎ

১৫

চট্টগ্রামে জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার বাঘা শরীফ

১৬

সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরলেন শিক্ষামন্ত্রী 

১৭

৭৩ বছরে ছাত্র ইউনিয়ন  

১৮

কৃষক খুনের ঘটনায় থামছে না ভাঙচুর ও লুটপাট

১৯

হজের জন্য অনুমতি দেওয়া শুরু করেছে সৌদি আরব

২০
*/ ?>
X