প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৩, ১২:৫৯ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় পার্টির বিরোধী দল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা

জাতীয় পার্টির বিরোধী দল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা

বইয়ের নাম ‘দেশরত্ন শেখ হাসিনার স্বর্ণযুগ’। বইটির লেখক একজন সংসদ সদস্য, নাম রওশন আরা মান্নান। প্রকাশনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এবার আপনাদের জন্য একটা কুইজ, এ বইয়ের লেখক কোন দলের সংসদ সদস্য। যারা ব্যক্তিগতভাবে রওশন আরা মান্নানকে চেনেন, তাদের কথা আলাদা। আমার মতো যারা তাকে চেনেন না, তারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, রওশন আরা মান্নান আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। দলীয় প্রধানকে সন্তুষ্ট করতে তার শাসনামলের প্রশংসা করে আওয়ামী লীগের একজন এমপি এমন একটি বই লিখতেই পারেন। রাজনীতিবিদরা যত লিখবেন, যত পড়বেন; ততই জাতির জন্য মঙ্গল। সেই বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানেই ওবায়দুল কাদের আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘দেশে রাজনীতিবিদদের মধ্যে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সাধারণত তাদের পড়ালেখার গভীরতা কম। বিদেশে বাসে বসে, ট্রেনে বসে অহেতুক গল্পগুজব করে কেউ সময় নষ্ট করেন না। একজন নেতাকে অবশ্যই পাঠক হতে হবে।’ তাই একজন সংসদ সদস্যের বই লেখার খবরটি অবশ্যই আনন্দের। যিনি লেখক, আশা করি তিনি পাঠকও।’

সমস্যাটা হলো, শেখ হাসিনার স্বর্ণযুগ নিয়ে যিনি বই লিখেছেন এবং যার বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক; তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নন। রওশন আরা মান্নান জাতীয় পার্টির সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য। আমরা সবসময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্য চাই, পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা চাই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, প্রধান বিরোধী দলের একজন সংসদ সদস্য সরকারের শাসনামলকে ‘স্বর্ণযুগ’ অভিহিত করে বই লিখে ফেলবেন। শেখ হাসিনার শাসনামলকে স্বর্ণযুগ মনে করার লোক দেশে অনেক আছেন। কিন্তু রওশন আরা মান্নান যদি শেখ হাসিনার শাসনামলকে স্বর্ণযুগ মনেই করেন, তাহলে তার উচিত জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া। আমি খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি, রওশন আরা মান্নান এর আগে জাতীয় পার্টির শাসনামল বা এরশাদের প্রশংসা করে কোনো বই লিখেছেন কিনা। পাইনি। জাতীয় পার্টি বা এরশাদের শাসনামলের প্রশংসা করে লেখার মতো কিছু নেই, অন্তত আমার দৃষ্টিতে। কিন্তু জাতীয় পার্টি করেন, সেই দলের মনোনয়নে এমপি হন; তার চোখে তো জাতীয় পার্টির শাসনামলকেই স্বর্ণযুগ মনে হওয়ার কথা। রাজনীতির হিসাবে বর্তমানে জাতীয় পার্টির প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারি দল আর জাতীয় পার্টি জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল। তো প্রধান বিরোধী দলের কোনো এমপির চোখে যদি সরকারি দলের শাসনামলকে স্বর্ণযুগ মনে হয়, তাহলে বুঝতে হবে রাজনীতিতে বড় রকমের ওলটপালট হয়ে গেছে।

অবশ্য রওশন আরা মান্নান একা নন, জাতীয় পার্টিতে সরকারি দলের আরও অনেক দালাল আছেন। এ অভিযোগ অবশ্য আমার নয়। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় পার্টির যৌথসভায় এ অভিযোগ করে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল আলম বলেছেন, ‘সংসদে জাপার এমপিরা বিরোধী দলের আসনে বসে সরকারের চাটুকারিতা করছেন। এতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।’ তার বক্তব্য নিয়ে বৈঠকে হট্টগোল হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি ভুল কিছু বলেননি। এটা বাংলাদেশের সবাই জানেন। জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে প্রধান বিরোধী দল এবং সরকারি দলের মহাজোটের সঙ্গী। বর্তমানে নেই বটে, তবে গত মেয়াদেও জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে প্রধান বিরোধী দল এবং সরকারের অংশ ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসেই এমন ঘটনা বিরল।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তীব্র গণআন্দোলনের মুখে পতন ঘটেছিল স্বৈরাচারী এরশাদের। তখন কেউ ভাবেওনি এরশাদ আবার বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাবেন, জাতীয় পার্টি কখনো সংসদে প্রধান বিরোধী দল হবে। কিন্তু ওই যে ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ এই অশ্লীল কথাটি বলে রাজনীতিবিদরা তাদের সব অপকর্ম জায়েজ করে নেন। এরশাদও মাত্র ১০ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে নিজেকে জায়েজ করে ফেলেন। প্রথমে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে জেল থেকে মুক্ত হন এরশাদ। পরে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় আসে। তখনই আওয়ামী লীগ বুঝে যায় বিএনপি-জামায়াতের সম্মিলিত ভোটের সঙ্গে তারা পেরে উঠবে না। তাদেরও একটা এক্সট্রা ভোটব্যাংক লাগবে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতের বাইরে ভোটব্যাংক আছে শুধু জাতীয় পার্টির। তাই আওয়ামী লীগ কাছে টানে জাতীয় পার্টিকেই। স্বৈরাচারের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের পুরোনো জোট ১৪ দলের অনেকের আপত্তি ছিল বলে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মহাজোট বানায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট বিশাল জয় পায়। তারপর থেকে আওয়ামী লীগ আর জাতীয় পার্টি তামাক আর ফিল্টার, দুজনে দুজনার। তবে এরশাদ বেঁচে থাকতে আওয়ামী লীগের কবল থেকে জাতীয় পার্টিকে বাঁচানোর ব্যাপক চেষ্টা করেছেন। সমস্যা হলো, দলে তো বটেই, এরশাদের পরিবারের ভেতরেও আওয়ামী লীগের দালালে ঠাসা। বারবার চেষ্টা করেও এরশাদ পারেননি। এরশাদ বেশি বিপ্লব করলে মঞ্জুর হত্যা মামলার তারিখ পড়ত। তাতেই তিনি আবার পোষ মেনে যেতেন। কারণ কারাগারে থাকার কষ্টটা তিনি জানতেন। আর কখনো কারাগারে যেতে চাইতেন না তিনি। তাই জাতীয় পার্টিরও আর বিরোধী দল হওয়া হয়ে ওঠেনি। এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে আসেন তার ছোট ভাই জি এম কাদের। তিনিও ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল বানানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এখানেও ঘরের শত্রু বিভীষণ। জাতীয় পার্টিতে দুটি ধারা স্পষ্ট—একটি সরকারপন্থি, অন্যটি বিরোধীপন্থি। জি এম কাদের বিরোধীপন্থি আর তার ভাবি রওশন এরশাদ সরকারের সঙ্গে মিলেমিশেই থাকতে চান। এরশাদের মতো জি এম কাদেরকে নিয়ন্ত্রণেও বেছে নেওয়া হয়েছে মামলার কৌশল। এরশাদের মতো জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। তাই তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে জাতীয় পার্টিরই এক নেতাকে। দলের সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধার করা মামলায় আদালত জি এম কাদেরের দলীয় কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। আদালতের নির্দেশে দীর্ঘদিন জি এম কাদেরকে চুপ থাকতে হয়েছে। আদালতের নির্দেশে কোনো ব্যক্তির রাজনীতি থেকে বিরত থাকার নজিরও খুব বেশি নেই।

শুরুতে যে যৌথসভার কথা বলা হয়েছে, সে সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, জাতীয় পার্টি সরকারের সমালোচনায় মুখর থাকবে। শুধু জহিরুল হক নন, আরও অনেকেই দাবি তোলেন, জাপার এমপি ও নেতারা যেন সরকারের চাটুকারিতা না করেন। কেউ চাটুকারিতা করলে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান তারা। আর নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত হওয়ার পর এবারই প্রথম জি এম কাদের দলের কোনো সভায় যোগ দিলেন। সভায় তিনি বলেছেন, ‘স্বতন্ত্র অবস্থান রেখে জাপা নিজস্ব রাজনীতি করবে। কারও দালালি করবে না।’ আর সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে আবার নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়লে তা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করারও সিদ্ধান্ত হয় সভায়।

যৌথসভায় আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলেও জানানো হয়। গত দুটি নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি এ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় পার্টি নিজস্ব অবস্থানে থেকে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে নাকি আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে সমঝোতায় নির্বাচন করবে, এটা আসলে নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের ওপর। জাতীয় পার্টি এখানে পুতুল মাত্র। যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে জাতীয় পার্টিকে অবশ্যই আওয়ামী লগের সঙ্গে মিলে নির্বাচন করতে হবে। আর বিএনপি না এলে হয়তো জাতীয় পার্টিকে আবারও গৃহপালিত বিরোধী দলের আসনেই বসতে হবে। জাতীয় পার্টির হয়তো আর সত্যিকারের বিরোধী দল হওয়া হবে না।

তবে একটা দেশের প্রধান বিরোধী দলকে যৌথসভা করে সরকারের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাও মেয়াদের শেষ বছরে এসে; এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে। জাতীয় পার্টির বিরোধী দল হওয়ার চেষ্টার কথা শুনলে আমার খালি কুঁজোর চিত হয়ে শোয়ার ইচ্ছার কথা মনে হয়।

প্রধান বিরোধী দলের সরকারের দালাল হওয়াটা রাজনীতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক বটে। তবে আমার কিন্তু খারাপ লাগে না। আমরা যারা আমাদের যৌবন ব্যয় করেছি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে, জাতীয় পার্টির আজকের না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থা আমাদের এক ধরনের আনন্দ দেয়। জাতীয় পার্টিকে একেবারে ঠেকাতে হয়তো পারিনি, তবে তাদের এ অসহায়ত্ব দেখাটাও এক ধরনের পুলক আনে মনে।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কাশ্মীরে যাত্রীবাহী গাড়ি গভীর খাদে, নিহত ১০

যুক্তরাষ্ট্রের জার্সিতে খেলবেন সাবেক কিউই তারকা

রাজার আমন্ত্রণে ভুটানে তথ্য প্রতিমন্ত্রী

নেতাকে ফাঁসাতে গিয়ে আ.লীগ কর্মী গ্রেপ্তার

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশ / স্বাধীনতা দিবসের নামে চাঁদা দাবি করায় ইউএনওর ২ স্টাফ বদলি

স্কুটারে বসেই অফিস করছেন তিনি, ভিডিও ভাইরাল

মোস্তাফিজদের ম্যাচ দেখায় নতুন রেকর্ড

এখনো যুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে ফিলিস্তিনিরা

‘বিএনপি নেতাদের কথা শুনলে জিয়াউর রহমানও লজ্জা পেয়ে যেতেন’

কুমিল্লায় গত ১১ মাসে শতাধিক মামলায় গ্রেপ্তার ৪৬৭

১০

বৃষ্টি হলেই সড়ক হয়ে যায় পুকুর, জনদুর্ভোগ চরমে

১১

ব্রিটিশ গণমাধ্যমের তালিকা / পেলে-ম্যারাডোনা নয় সর্বকালের সেরা মেসি

১২

আইপিইউ সম্মেলন শেষে দেশে ফিরলেন স্পিকার

১৩

৫ হাজার মূল্যের বাতি ২৭০০০ টাকায় কিনেছে রেল!

১৪

মেট্রোরেলের ওপর দিয়ে যাওয়া ইন্টারনেট-ডিসের তার অপসারণের নির্দেশ

১৫

২০০ বছরের পুরোনো ‘গায়েবি’ মসজিদের গুপ্ত তথ্য

১৬

বিএনপির নেগেটিভ রাজনীতি মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে : ওবায়দুল কাদের

১৭

জজশিপের কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে দুদিনের কর্মশালা অনুষ্ঠিত

১৮

সিরিয়ায় ইসরায়েলি বিমান হামলা, নিহত ৩৬ সেনা

১৯

জাভির পর কে হবেন বার্সা কোচ!

২০
*/ ?>
X