অভিধানে ‘খেলা’ শব্দের মানে হচ্ছে ক্রীড়া (বল নিয়ে খেলা); কৌতুক বা পারদর্শিতা প্রদর্শন (সাপ খেলা, ছোরা খেলা); লীলা, অবস্থাবিশেষের আচরণ (‘এই খেলা তো শেষ খেলা নয়’: রবীন্দ্র); ভোজবাজি (ভানুমতির খেলা)। খেলা করা (ছেলেরা মাঠে খেলছে); স্ফুরিত বা বিকশিত হওয়া (মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল); বুদ্ধিযুক্ত হওয়া (অঙ্কটা তার মাথায় ঠিক খেলে না)। ইচ্ছামতো পরিচালিত করা (মাছটাকে খেলাচ্ছি, পুলিশ চোরকে খেলাচ্ছে)। তবে আরও এক ধরনের খেলা রয়েছে যাকে বলে ভাগ্যের খেলা বা জুয়া খেলা।
খেলাধুলা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এগুলো একক বা দলীয় ভাবে হতে পারে। আরও এক ধরনের খেলা রয়েছে যা অনলাইনে খেলা হয়। এ ধরনের খেলায় খেলোয়াড়দের প্রতিপক্ষের সামনে উপস্থিত না হয়েও খেলা যায়। খেলাধুলার সময় খেলোয়াড়দের পাশাপাশি দর্শকও থাকতে পারে, যারা খেলা দেখে উপভোগ করে। আবার কিছু কিছু খেলায় খেলোয়াড়রা নিজেরাই দর্শক হয়ে পালাবদলের মাধ্যমে খেলে। শিশুরা এভাবে খেলতে পছন্দ করে। তারা পালাবদলের মাধ্যমে ঠিক করে কে খেলবে আর কে দর্শক হবে।
খেলাধুলার মূল উপাদানগুলো হলো খেলার লক্ষ্য, নিয়ম-কানুন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং উপস্থিত বুদ্ধি। খেলাধুলা সাধারণত মানসিক বা শারীরিক অথবা উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্কিত। অনেক ধরনের খেলা রয়েছে যা একজনের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে, শরীরচর্চার মতো কাজ করে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগুলো শিক্ষা ক্ষেত্রে, মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও কাজ করে।
ক্রীড়া ক্ষেত্রে সাফল্য খুব কম হলেও বাঙালি সবসময় খেলার মধ্যেই থাকে। রাজনীতিতেও এখন জনপ্রিয় বাক্য হলো : ‘খেলা হবে!’ তাস-পাশা-দাবার চাল থেকে ধার করে বাঙালি হুমকি দেয় : ‘এবার এমন চাল দিব যে ও বাপের নাম ভুলে যাবে।’ ভীষণ কুটিল প্রকৃতির লোকও সমাজে পরিচিতি পায় ‘ঝানু খেলোয়াড়’ হিসেবে। বাঙালির কাছে রাজনীতিও খেলা, আবার খেলাও খেলা। যদিও খেলার সঙ্গে রাজনীতির অনেকেই ফারাক রাখতে চান। বলতে চান খেলা হচ্ছে খেলা, এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। আসলে মোটেও তা নয়! খেলার মাঠে রাজনীতি ঢুকেই পড়ে। ‘খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাবেন না!’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এ ধরনের উপদেশবাণী আজকাল খুবই পরিচিত হয়ে গেছে। যখনই কেউ কোনো দলের প্রতি সমর্থনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতাদর্শকে টেনে আনে, ‘নিরপেক্ষ’ শ্রেণির কিছু মানুষকে এ জাতীয় কথাবার্তা বলতে শোনা যায়। তাদের মতে, খেলাধুলা খুবই পবিত্র একটি বিষয়। রাজনীতির মতো জাগতিক কলুষিত জিনিসের সঙ্গে খেলাধুলার সংমিশ্রণ মোটেই কাম্য নয়।
সাধারণ অর্থে খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশানো কথাটির মাধ্যমে আমরা কিছুটা ভিন্ন অর্থ বুঝিয়ে থাকি। এর মাধ্যমে আমরা বোঝাই, খেলাধুলার মাধ্যমে যখন কূটনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করা হয়, কিংবা খেলাধুলাকে নিজস্ব মতাদর্শ প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
যুগে যুগে অসংখ্য মানুষ খেলাধুলার সঙ্গে রাজনীতির এমন সম্পৃক্ততার বিরোধিতা করে এসেছে। কিন্তু তাদের আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া খুব কমই মিলেছে। শুধু বর্তমান সময়ই না, সব যুগের সব মানুষই যখনই পেরেছে, খেলাধুলা ও রাজনীতিকে একই সুতায় এনে বেঁধেছে।
প্রমথ চৌধুরী ১৯১৫ সালে রচিত তার ‘সাহিত্যে খেলা’ নামের এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘মানুষের দেহমনের সকল প্রকার ক্রিয়ার মধ্যে ক্রীড়া শ্রেষ্ঠ, কেননা তা উদ্দেশ্যবিহীন।’ ওই প্রবন্ধে তিনি ‘উদ্দেশ্যবিহীন’ বলতে আনন্দদায়ক বোঝাতে চেয়েছেন। তার মতে, খেলা উদ্দেশ্যবিহীন এবং আনন্দদায়ক বলেই কলকাতার টাউন হলের দেশহিতকর বক্তৃতার চেয়ে ‘গড়ের মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে’ মানুষ বেশি যায়। খেলা সম্পর্কে, বিশেষত ফুটবল খেলা সম্পর্কে, প্রমথ চৌধুরীর এ বক্তব্য খুবই সরল এবং বাছবিচারহীন বলেই মনে হয়। বাংলা অঞ্চলে ফুটবল খেলাকে ছেলেখেলা হিসেবে দেখা খুব মুশকিল। বাংলায় ফুটবলের সাংস্কৃতিক-রাজনীতি আছে, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ব্যাপার-স্যাপার আছে, আছে শ্রেণিচরিত্র।
খেলা শব্দের নিকটতর অনুষঙ্গ কোনটি? রণ না রমণ? জয়দেবের গীতগোবিন্দ অনুসরণ করলে মনে হয় দ্বিতীয়টি। আর মহাভারতের সভাপর্বের ভাষ্য অনুযায়ী প্রথমটিই প্রথমে মনে আসে। কোথায় খেলার সঙ্গে আনন্দের যোগ? হয়তো ছন্দে, নৃত্যপরতায়। বিজ্ঞানও সায় দেবে এ কথার। নাড়ির গতি, শ্বাসের ওঠাপড়া, নিদ্রা, ঋতুস্রাব, এমনকি সূক্ষ্মতর স্তরে দেহকোষের শক্তিচক্র, সর্বত্রই এ ছন্দের খেলা। অন্তর্নিহিত এ ছন্দকে যখন কোনো ক্রিয়ার মাধ্যমে অন্যের দৃষ্টিগোচর করে তোলে, তখন তাকে আমরা শিল্প বলি। লিওনেল মেসি যখন বলকে পায়ের চেটোয় ঠুকে পর্যায়ক্রমে বাঁদিক ও ডানদিক করে বিপক্ষের রক্ষণকে বিভ্রান্ত করতে থাকেন, তখন আমরা বুঝি ওই তুঙ্গমুহূর্তে যা ক্রিয়াশীল, তা আসলে এক জাদুশক্তি যার উৎস দেহের স্বতঃস্ফূর্ত নৃত্যপরতায়। তার সঙ্গে যোগ করতে হবে খেলাকে ঘিরে মানুষের মহামিলনের উপরি পাওনা।
পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ মেতে থাকে যে খেলাকে ঘিরে, অথচ সেই ফুটবল নিয়ে কোনো সমালোচনা হয় না, বুদ্ধিচর্চার জগতে সবচেয়ে উপেক্ষিত বিষয় এটি। তার একটা কারণ অবশ্যই ভাবুক বুদ্ধিজীবীদের খেলাধুলা সম্বন্ধে তাচ্ছিল্য ও অনাগ্রহ। দ্বিতীয় কারণ হয়তো পেশাদারি ক্রীড়াজগৎ অনেকটা স্বৈরতন্ত্রের মতো, তাকে নিয়ে গভীর কোনো প্রশ্ন বা পর্যালোচনাকে মনে করা হয় অপরাধ। কদাচিৎ কোনো বুদ্ধিজীবী যখন বিষয়টি নিয়ে কলম ধরেন তখন নিজের বুদ্ধিবৃত্তির নিরোধ হয়ে ওঠে প্রায় আবশ্যিক। আলবের কাম্যুর মতো বিশ্ববন্দিত ভাবুক পেশাদারি ফুটবলের মধ্যে সারল্য ও মানবিক কর্তব্যকে আবিষ্কার করে ফেলেন।
প্রশ্নাতীত পেশাদারি ক্রীড়াজগতে শুধু একটি প্রশ্নের অবাধ অনুমতি এবং সর্বাত্মক উপস্থিতি—জিতবে কে? খেলা নয়, খেলার ফলটাই আসল। কটা গোল, কত রান, কত পয়েন্ট—এ নিয়েই যাবতীয় জল্পনা, আদান-প্রদান। আমাদের দৈনন্দিন সামাজিকতাও এ সংখ্যাতত্ত্বের একনায়কত্বের ওপর নির্ভরশীল। এদিকে, সাদা চোখে দুটি দলের মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ধরা পড়ে তার নিচ দিয়ে সহস্রধারায় বয়ে চলে ব্যক্তিগত রেষারেষির চোরাটান। কে বেশি টানতে পারে ক্যামেরার আলো, মিডিয়ার প্রসাদ? এসব বুঝতে পারেন শুধু প্রশিক্ষকরা। সুতরাং, ফুটবল সে অর্থে মোটেই সমষ্টিগত কোনো খেলা নয়, বরং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এমনকি স্বার্থপরতা এর চালিকাশক্তি। ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতা, যোগ্যতমের ঊর্ধ্বতন। তঞ্চকতার বৈধতা ইত্যাদি মিলিয়ে পেশাদারি খেলার নৈতিক কাঠামোটা অবাধ পুঁজিবাদী মূল্যবোধের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
খেলার আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের বেশ কিছু মিল আছে। এমন মিল যে, পেশাদারি ক্রীড়ানুষ্ঠানকে মনে হতে পারে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্যারোডি। যেমন মাঠে নামার আগে মাটি ছুঁয়ে মাথায় বা বুকে হাত ছোঁয়ানো, গোল করার পর হাঁটু মুড়ে বসে দুই হাত আকাশে তুলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ভিক্ষা, আরতির ঢঙে বিজেতার কাপ ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, শান্তিস্বস্ত্যয়নের ঢঙে শ্যাম্পেইন ছেটানো।
কেউ মানুক আর না মানুক, খেলাধুলার সঙ্গে রাজনীতি কোনো না কোনোভাবে ঠিকই এসে যায়। মিশে যায়। কখনো খেলাধুলা সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনাকে নাড়া দেয়, আবার কখনো খেলাধুলা দুই দেশের সম্পর্কের উষ্ণতায় ভূমিকা রাখে। খেলাধুলার মতো এত বিপুল অনুসরণকারী যেহেতু আর কোনো বিনোদন মাধ্যমেরই নেই, তাই যে কোনো ব্যক্তিবিশেষ কিংবা গোষ্ঠী তাদের প্রতিবাদের ক্ষেত্র হিসেবে খেলাধুলাকেই বেছে নেয়।
দিন শেষে খেলাধুলা শুধু মাঠের লড়াইতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, মাঠের বাইরের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সমীকরণও মিলিত হয়ে সেটিকে তাৎপর্যময় করে তোলে। এমতাবস্থায় কেউ চাইলেই খেলাধুলা আর রাজনীতিকে আলাদা করতে পারবে না। খেলাধুলা আর রাজনীতি তাদের আপন গতিতেই পরস্পরের সমান্তরালে এগিয়ে যাবে। সুতরাং ‘খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাবেন না’ এটা অসার আহ্বান হতে বাধ্য।
আমরা স্রেফ এটুকু আশা করতে পারি যে, খেলাধুলার সঙ্গে যেন অসুস্থ রাজনীতি না মেশে, ঘুণেধরা রাজনৈতিক অচলাবস্থা যেন ক্রীড়া ক্ষেত্রকেও কলুষিত করে না দেয়। বরং খেলাধুলা হোক সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধশক্তি।
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী