যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের কাছে তথ্য তুলে ধরার জন্য লবিস্টরা কাজ করে থাকেন। লবিস্টরা কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, এমনকি কোনো দেশের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে প্রভাব বিস্তার করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের তথ্য দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের জন্যও তথ্য তুলে ধরা এই লবিস্ট ফার্মের কাজ। এই পেশায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান বা ফার্ম রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। তথ্যমতে, গত বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৪৮০টি লবিস্ট ফার্ম বা প্রতিষ্ঠান ছিল। লবিস্ট ফার্মকে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের কাছে নিবন্ধন করতে হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড তদারকি করে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের ন্যাশনাল সিকিউরিটি বিভাগ। লবিস্ট প্রতিষ্ঠান যখন কাজ নেয়, তখন প্রতিষ্ঠানটি সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রতিষ্ঠানটি কাজের বিনিময়ে কত অর্থ পাবে, সেটিও চুক্তিতে থাকে। যদিও বেশিরভাগ মানুষই অর্থের বিনিময়ে কাজ করা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে লবিস্ট বলে। তবে পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক লবিস্টও রয়েছেন।
প্রায়ই শোনা যায়, নিজেদের স্বার্থে দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলের একটি জোট লবিস্ট নিয়োগ করেছে, যা নিঃসন্দেহে দেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রকৃত কর্মকাণ্ড বিশ্বের বুকে তুলে ধরার জন্য লবিস্ট আছে কি? এ বিষয়ে জনমনে প্রশ্ন জাগতেই পারে! আমরা যারা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সরকারের কর্মকাণ্ডকে পর্যবেক্ষণ করি, তারা বিশ্বাস করি শেখ হাসিনার লবিস্ট এ দেশের সাধারণ জনগণ। যারা প্রকৃত অর্থেই দেশের উন্নয়ন চায়। যারা ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখে। আমি বিশ্বাস করি ‘যিনি হৃদয় দিয়ে কাজ করেন, তার জীবন কর্মের মহিমায় পরিপূর্ণ।’ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে দুবাই এক্সিবিশন সেন্টারে আয়োজিত ‘রিডিফাইনিং দ্য ফিউচার অব উইমেন’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মায়ের মমতা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করলে জনগণ অবশ্যই সমর্থন করবে।’ তার কথা এবং কাজের মধ্যে শতভাগ মিল আছে বলেই বাংলাদেশ আজ প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়নের ধারায় অগ্রগামী।
স্বাধীনতার পর ৫০ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে আসা বাংলাদেশ সামরিক শাসনসহ অনেক শাসনব্যবস্থা দেখেছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশ পরিচালনার ভার ছিল বিএনপির হাতে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালের ‘চেপে বসা দুঃশাসন’ পেরিয়ে আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের বিস্ময়। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের মোট বাজেট ছিল ৬১ হাজার ৬ কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। বিগত ১৫ বছরে আর্থ-সামাজিক খাতে এক অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ২০০৬ সালে জিডিপির আকার ৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা ছিল, তা ২০২১ সালে বেড়ে ২৮ লাখ কোটি টাকার অধিক হয়েছে। ২০০৬ সালে জিডিপির বৃদ্ধি ছিল ৫.০৪। আর করোনাকালীন ২০২১ সালে ৬.১ জিডিপি অর্জিত হয়েছে। ২০০৬ সালে জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার, যা ২০২১ সালে ২ হাজার ৫৫৩ ডলারে উন্নীত হয়, বৈদেশিক রিজার্ভ ছিল ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। বিএনপির শাসনামলে খাদ্য ঘাটতি থাকলেও ২০২১ সালে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ২০০৬ সালের রপ্তানি আয় ১০.৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থাকলেও ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। সেবা খাতসহ রেমিট্যান্স আয় ৪.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হলেও ২০২১ সালে তা ২৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। ২০০৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ, যা ২০২১ সালে ২১ শতাংশের নিচে নেমে আসে।
সমুদ্রসীমা জয়ের কৃতিত্ব আওয়ামী লীগ সরকারের ঝুলিতে জমা রয়েছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, পায়রা বন্দর, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, দরিদ্রদের জন্য ঘর উপহার, গড় আয়ু বৃদ্ধি, স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ, কমিউনিটি ক্লিনিক, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি (৩২০০ মেগাওয়াট থেকে ২৪৪২১ মেগাওয়াট), বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, মডেল মসজিদ কাম-ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেস নির্মাণ, মেট্রোরেল চালু ইত্যাদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও ঐকান্তিকতার ফসল। এ ছাড়া ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ এবং ডেলটা প্ল্যান ২১০০ সালের রূপরেখা ঘোষণা তার দেশপ্রেমিক মননের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন। বর্তমানে দেশব্যাপী সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আউটসোর্সিং করে তারা কয়েকশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কৃষি খাতে বাংলাদেশের অর্জন ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশ বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, চাল উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম, আউটসোর্সিংয়ে অষ্টম, আলু উৎপাদনে সপ্তম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মৌসুমি ফল উৎপাদনে দশম, পাট রপ্তানিতে প্রথম, মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম। পরিসংখ্যান বলে, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন আমাদের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট।
মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে পৃথিবীর প্রায় সব দেশই বিপর্যস্ত হয়েছিল। এই ভাইরাসে বাংলাদেশের অবস্থাও ছিল নাজুক। সেই পরিস্থিতি থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সফলতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফোর্বস থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মিডিয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছে। করোনার রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের যে দেশগুলোতে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ছিল, তারাও বিদ্যুতের অভাবে মোমবাতি জ্বালিয়ে রেস্টুরেন্টের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্য সরবরাহে সমতা বিধানে কোনো কোনো দেশের নাগরিকের দুটির বেশি টমেটো কেনার ওপরে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এমন বৈরী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
দেশ পরিচালনায় শেখ হাসিনার মমতা, সততা, ধৈর্য, আন্তরিকতা, একাগ্রতা ও দক্ষতা সর্বজনবিদিত। মায়ের প্রতিভূ, বোনের প্রতিচ্ছায়া—এমন বিশ্বনেত্রীর জন্য আলাদা কোনো লবিস্ট প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। বাংলার সাধারণ জনগণই তার প্রকৃত লবিস্ট।
লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়