সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৩, ০৯:০৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গণপরিবহনের ডিএনএতেই বিশৃঙ্খলা

গণপরিবহনের ডিএনএতেই বিশৃঙ্খলা

আমরা প্রায়ই বলি আমাদের চৈতন্য হোক। কিন্তু সত্যিই চৈতন্য হয় না আমাদের। না হলে কেন আমরা অন্ধ মানসিকতা থেকে বের হতে পারি না? একথাটা বেশি প্রযোজ্য বাংলাদেশের সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ এত উন্নয়ন করছে, চোখ ধাঁধানো সব প্রকল্প করছে, বড় বড় সেতু আর সড়ক নির্মাণ করছে, কিন্তু সড়কে চলছে আদিম অসভ্যতা।

রাজধানী ঢাকার সড়ক চিত্র জঙ্গলকেও হার মানায়। একদিকে সড়কের স্বল্পতা, অন্যদিকে সারা বছর খোঁড়াখুঁড়ি। সারা বিশ্ব, এমনকি পাশের দেশের একটি প্রাদেশিক রাজধানী কলকাতাতেও যখন সবকিছু ডিজিটাল, তখন আমাদের এখানে ট্রাফিক পুলিশের হাতই ভরসা। বাসগুলোর চেহারা এবং বাসের চালক ও হেল্পারের আচরণ দেখলে কোনো স্বাভাবিক মানুষ বিপদে না পড়লে সেসব বাসে উঠার কথা না। এর বাইরে প্রচণ্ডভাবে আছে এলোপাতাড়ি চলা ও পার্কিং এবং পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সম্মিলত নৈরাজ্য।

ঢাকায় বাস চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে চালু হয়েছে ঢাকা নগর পরিবহন। এই পরিবহনের বাস নির্দিষ্ট জায়গায় থামে, ভাড়া বাড়তি নেওয়া হয় না। নগর পরিবহনের বাস অন্য বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতাও করে না। বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি এটি করেছে বাস মালিক ও শ্রমিক নেতা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেই। কিন্তু এখন শুরু হয়েছে এক প্রকার পেশি প্রদর্শনী। কথা দিয়েও বাস মালিকরা সংশ্লিষ্ট রুটগুলোতে রুট পারমিটবিহীন বাস চলা বন্ধ করছেন না। তারা বলছেন, রুট পারমিটবিহীন বাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো যাবে না।

কতটা উচ্ছৃঙ্খলতা প্রিয় হলে এমনটা কেউ দাবি করতে পারে যে, একটা অন্যায় ও অনিয়মকে, তথা দুর্নীতিকে বিনা বাধায় চলতে দিতে হবে। কোনো যুক্তি নেই, তবে আছে রাজনীতি। মালিকরা বারবার একটা কথা বলেন যে, আওয়ামী লীগের দুর্দিনে আন্দোলন-সংগ্রামে এবং ২০১৪-১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনায় সরকারের পক্ষে ঢাকা শহরে চলাচলকারী গাড়ির মালিক-শ্রমিকরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। এই ভূমিকা কী তবে সড়কে বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রাখার লাইসেন্স? নাকি দেশের পরিবহন খাতের ডিএনএতেই আছে বিশৃঙ্খলা? শৃঙ্খলাভঙ্গের প্রবণতা কি আমাদের পরিবহন সংস্কৃতির প্রধান উপাদান? নাকি বাংলাদেশের গণপরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা আলাদা প্রজাতি, যাদের স্বভাবে এই প্রবণতা বিশেষ জোরালো? এই প্রশ্নগুলো আমাদের ভাবিয়ে তোলে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের পক্ষ থেকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ১১ দফা দাবির কথা বলা হয়েছে যার মোদ্দা কথা হলো, ঢাকায় বাস রুট পুনর্বিন্যাসের নামে বিভিন্ন রুটে বাস চলাচলে বাধা দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ অন্যায় কাজ চালিয়ে যেতে দিতে হবে। এসব দাবি অযৌক্তিক, তবে তার চেয়েও বেশি আতঙ্কের যে এর মাধ্যমে তারা সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অনুমোদন আদায় করে নিতে চাচ্ছে। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে ও দুর্ঘটনা কমাতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিতে চায় তার সবগুলোতেই বাধা দেয় পরিবহন মালিকরা। আর এদের সঙ্গে থাকে তাদের শ্রমিকরা। বাংলাদেশের গণপরিবহন ব্যবসা একমাত্র ব্যবসা যেখানে মালিক শ্রমিকের একটা ভয়ংকর ঐক্য আছে নৈরাজ্যের পক্ষে।

রাজধানীতে বাস চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে অনেক আগেই রুট পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এদের বিরোধিতায় সেটি কার্যকর করা যায়নি। অনেক আলোচনার পর এ পর্যন্ত তিনটি রুটে সমন্বিত পদ্ধতিতে বাস চালু হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য রুটেও চালু হওয়ার কথা আছে। ঢাকার মানুষ একে স্বাগত জানিয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনিসুল হক হাতিরঝিল-গুলশান রুটে এই পদ্ধতিতে বাস চালু করেছিলেন, যার সুফল যাত্রীসাধারণও পাচ্ছেন। আমাদের সবার মনে থাকার কথা ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে দুই কোম্পানির বাসের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে ক্যান্টনমেন্ট শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা দেশব্যাপী নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে এবং সরকার সড়ক পরিবহন আইন করতে বাধ্য হয়, যদিও সেই আইন কার্যকর করতে দেয়নি পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা।

এখন এই মালিক-শ্রমিক নেতারা মিলে ঢাকার পুনর্বিন্যাসিত রুটের মতো একটা ক্ষুদ্র উদ্যোগকেও ব্যর্থ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা নিয়েছে। এই রুটে অন্যান্য কোম্পানির বাস চালানোর সুযোগ দেওয়ার দাবির অর্থই হলো নৈরাজ্য সৃষ্টি করা। আরও যেসব অন্যায় দাবি তাদের আছে দুর্ঘটনার কারণে চালকদের শাস্তি কমানো এবং ঢাকা শহরের বাইরে টার্মিনাল না হওয়া পর্যন্ত শহরের বাস কাউন্টারগুলো বন্ধ না করা। অথচ তারা নিজেরাও স্বীকার করেন যে, ঢাকা শহরে যানজটের অনেক কারণের অন্যতম একটি হলো যত্রতত্র বাস কাউন্টার।

এসব দাবির চিঠিতে যারা সই করেছেন তাদের মধ্যে জাতীয় সংসদের একাধিক সদস্য রয়েছেন যারা ২০১৮ সালের পরিবহন আইনটি পাসের সময় সংসদে এর পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু তারা সংসদের বাইরে এসে নিজেদের তৈরি আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সড়কে নৈরাজ্যে উসকানি দিচ্ছেন।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে মালিক-শ্রমিকরা কখনোই সহায়তা করেননি। মালিক-শ্রমিকরা যা করতে চায় সবই পারছে করতে, কারণ ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে এদের প্রতি প্রশ্রয় আছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সরকারের উদ্যোগকে ভেস্তে দিতেই এখন সচেষ্ট এই মহল। সড়ক আইন রুখতে আমরা দেখেছি পরিবহন শ্রমিকরা গাড়ি ভাঙছে, রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ও চালক উভয়ের মুখে পোড়া মবিল লাগিয়ে দিচ্ছে। মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা এমনকি ভ্যানও চলাচল করতে তারা বাধা দিয়েছে। এগুলো তারা করেছে পুলিশের নাগের ডগায়, বিনা বাধায়। এতে করেই বোঝা যায় রাজনৈতিকভাবে কতটা ক্ষমতাশালী তারা।

এই শহরে তথা সারা দেশেই ট্রাফিক পরিকল্পনা আর ট্রাফিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে আদৌ কোনো বিরোধ নেই। পরিকল্পনা হবে, তবে তা মানবার বাধ্যবাধকতা নেই। পথচারীর ফুটপাত দখল করে আছে পরিবহন কাউন্টার আর হকার, ফলে তাকে সড়কেই হাঁটতে হয়। দুর্ঘটনায় পথচারীর মৃত্যু হলে দোষও দেওয়া হয় তাকেই। ভাঙাচোরা গর্তের সড়কে গাড়িচালকরা আইন অমান্যকারী, কেননা তাদের জন্য কোনো আইনই নেই। পুলিশও অসহায়, কারণ আইন যেটুকু আছে, গাড়িচালকরা ২৪ ঘণ্টা তাকে বুড়া আঙুল দেখিয়ে চলে। সুতরাং এই সুগভীর বিশৃঙ্খলা-জাল ভেদ করে সমস্যা সমাধানের আশা আর করতে পারছি না। এদেশের সড়ক ও গণপরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা ও পরিকল্পনা পরস্পরবিরোধী নয়, পরস্পরের পরিপূরক।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রচণ্ড গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা

আনোয়ার সিমেন্টে চাকরি, কর্মস্থল ঢাকা

মৌয়ালকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল বাঘ

এসআইকে পিটিয়ে মাথা ফাটানোয় গ্রেপ্তার ১৬

লন্ডন মাতাতে যাবেন জেমস

লোকসভা নির্বাচনে উত্তর প্রদেশ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

মার্কিন সংগীতশিল্পীর রহস্যজনক মৃত্যু 

সরকার চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে পতন অনিবার্য : রিজভী 

বিবর্ণ মোস্তাফিজে হতাশ বিশেষজ্ঞরা

ব্রাঞ্চ ম্যানেজার নেবে সীমান্ত ব্যাংক, ৪০ বছরেও আবেদন

১০

আ.লীগের সব রকম কমিটি গঠন ও সম্মেলন বন্ধ : ওবায়দুল কাদের

১১

মন্দিরে পূজা দিয়ে ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত

১২

তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যেই ৩ বিভাগে সুসংবাদ

১৩

শিবনারায়ণ দাসের প্রতি সর্বস্তরের শ্রদ্ধা

১৪

সাবমেরিন ক্যাবল বন্ধ, ইন্টারনেট স্বাভাবিক হবে কবে

১৫

বুয়েট : সমসাময়িক প্রেক্ষাপট ও কিছু প্রশ্ন

১৬

ফিটনেস টেস্টে তরুণদের ভিড়ে মুশফিকের চমক

১৭

জেলা পর্যায়ে নিয়োগ দিচ্ছে সূর্যের হাসি, আবেদন ২৫ বছরে

১৮

ইসরায়েলকে ১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রসহায়তা দিচ্ছে আমেরিকা

১৯

৫ দিনের ব্যবধানে হাতিরঝিলে ফের যুবকের মরদেহ উদ্ধার

২০
*/ ?>
X