মুক্তির সংগ্রাম এখনো পূর্ণতা পায়নি

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।পুরোনো ছবি

একাত্তরে নতুন ইতিহাস রচনার বিপ্লবী বার্তা গর্ভে ধারণ করে আবির্ভূত হয়েছিল অগ্নিঝরা সেই ‘উত্তাল মার্চ’। এ দেশের ইতিহাসে গণমানুষের সর্বাত্মক ও একতাবদ্ধ বিপ্লবী গণজাগরণের এরূপ দ্রুত ও পর্যায়ক্রমিক উল্লম্ফনের ঘটনা দ্বিতীয়টি আর ঘটেনি। এর আগে এ দেশের মানুষ সুদীর্ঘকাল ধরে গণসংগ্রাম ও গণআন্দোলনের অক্ষয়-অমর অনেক কীর্তি রচনা করেছিল। সেসব নিয়ে আলাদা আলাদা অনেক বীরত্বগাথা রচিত হতে পারে, হয়েছেও। অমর সেসব কীর্তির চূড়ান্ত সংশ্লেষণ ও উল্লম্ফন ঘটেছিল একাত্তরের ‘উত্তাল মার্চের’ ঘটনাপ্রবাহ ও তার প্রতিটি দিন-ঘণ্টা-মিনিটের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। দেশবাসীর সংগ্রাম উত্তরিত হয়েছিল স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য সশস্ত্র জনযুদ্ধে।

একাত্তরের ‘উত্তাল মার্চের’ ঘটনাবলি ব্যাপ্ত ছিল অতি সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ও ‘নেতাদের নির্দেশনা থেকে আরও এক কদম এগিয়ে থাকা’ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মাঝে। এটিই হলো পরিস্থিতির বিপ্লবী বিকাশের পথে অগ্রসর হওয়ার একটি স্বাভাবিক নিদর্শন। নেতৃত্বের দায়িত্ব ছিল, সেসব নিদর্শনকে অনুধাবন করে জনগণকে এগিয়ে যাওয়ার পথনির্দেশ করা। সে দায়িত্ব এসে বর্তেছিল, স্বাভাবিক কারণেই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর। কারণ মাত্র মাস দুয়েক আগেই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে পাকিস্তানের ‘প্রেসিডেন্ট ইন ওয়েটিং’ হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্যতা এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একচ্ছত্র সমর্থন প্রাপ্তির জোরে বাঙালি জাতির একক মুখপাত্র হওয়ার আইনি ও নৈতিক মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জাতিকে তার ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে সেই পথনির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। একাত্তরের ৭ মার্চ অপরাহ্ণে ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ১৮ মিনিটের ভাষণটি দিয়েছিলেন, সেটি সর্বাংশে ছিল একটি ‘ঐতিহাসিক’ ভাষণ। কেন এটি ছিল একটি ‘ঐতিহাসিক’ ভাষণ? কী কারণে একটি ভাষণ ‘ঐতিহাসিক’ বলে বিবেচিত হয়?

ইতিহাসে অনেক ‘ঐতিহাসিক’ ভাষণের খোঁজ পাওয়া যায়। সেসব কোনো কোনো ভাষণের প্রসঙ্গ মহাকাব্যে, নাটকে, উপন্যাসে, সাহিত্যে, সংগীতেও স্থান করে নিয়েছে। ধরা যাক, জুলিয়াস সিজারের অনুগত রোমান সেনাপতি মার্ক অ্যান্থনির ভাষণের কথা। মার্ক অ্যান্থনির অসাধারণ বাগ্মিতার গুণের কথা ইতিহাস থেকেই জানা যায়। সেই প্রমাণ্য তথ্যের ওপর নির্ভর করে ইংরেজ কবি উইলিয়াম শেকসপিয়ার তার ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকে মার্ক অ্যান্থনির একটি ঐতিহাসিক ভাষণ রচনা করে গেছেন। নাটকের দৃশ্যে, ব্রুটাস প্রমুখ বিশ্বাসঘাতকদের ছুরিকাঘাতে সিজারের হত্যাকাণ্ডের পর, সিজারের ক্ষতবিক্ষত লাশের পাশে দাঁড়িয়ে রোমের নাগরিকদের উদ্দেশে এটি ছিল মার্ক অ্যান্থনির ঐতিহাসিক ভাষণ। ঘাতকদের বিরুদ্ধে কোনো কটুবাক্য বলা হবে না এবং শুধু সিজারকে শেষ সম্মান জানিয়ে কিছু বলা হবে, এ শর্তে অনুমতি প্রাপ্ত হয়ে মার্ক অ্যান্থনি তার ‘ঐতিহাসিক’ সেই বক্তৃতায় ঘাতকদের অপপ্রচারে জন্ম নেওয়া সিজারবিরোধী মনোভাবকে সম্পূর্ণ উল্টিয়ে দিয়ে জনমতকে কয়েক মিনিটে ঘাতকদের বিরুদ্ধে গণক্রোধে পরিণত করতে সক্ষম হন। সেই বক্তৃতার ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তাতে ঘাতকরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। রোমের ইতিহাসের গতি ভিন্ন মোড় নেয়।

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের একটি বিপজ্জনক ক্রান্তিকালে সে দেশের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গেটিসবার্গ নগরে একটি ‘ঐতিহাসিক’ ভাষণ দেন। সর্বস্ব ত্যাগ করে হলেও দক্ষিণাঞ্চলের বর্ণবাদী-বিচ্ছিন্নবাদীদের অভিযান রুখে দিয়ে দেশের অখণ্ডতা ও গণতান্ত্রিক শাসনের মর্মবাণী সমুন্নত রাখার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। যুদ্ধের গতি ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এ ভাষণ এক ধরনের নির্ধারণমূলক ভূমিকা পালন করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনায়, ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে হিটলারের সৈন্যদের আক্রমণের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়া ব্রিটিশ সৈন্যদের ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে পশ্চাদপসরণের কাজে যার যা কিছু আছে তা দিয়ে সহায়তা করার জন্য ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল ইংরেজ নাগরিকদের প্রতি আবেদন জানিয়ে এক আবেগময় ভাষণ দেন। এ কল্পনাতীত সফল পশ্চাদপসরণের অভিযানে জনগণ সবরকম উপায়ে সহায়তা দিয়ে এক অসাধ্য সাধন করে। অধিকাংশ সৈন্য জীবন্ত পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এর ফলে হিটলারের হাতে ব্রিটেনের অনিবার্য পতন রোধ করা সম্ভব হয়। পরবর্তী সময় সোভিয়েত ও আমেরিকাসহ ‘এলাইড শক্তিতে’ ব্রিটেনের যোগদান ও ফ্যাসিবাদী হিটলার বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব হয়। চার্চিলের সেই ভাষণটিও ছিল একটি ‘ঐতিহাসিক’ ভাষণ।

একটি ভাষণ ঐতিহাসিক হয়ে ওঠে দুটি কারণে। ইতিহাসের ক্রান্তিকালীন মুহূর্তে প্রদত্ত একটি ভাষণ যখন একাধারে সমগ্র ইতিবাচক ঐতিহাসিক পটভূমির সারবত্তা ধারণ করতে সক্ষম হয় এবং একই সঙ্গে নতুন ইতিহাস রচনার জন্য সেই মুহূর্তের নির্দিষ্ট কর্তব্যকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়, তখনই সেটি ‘ঐতিহাসিক’ হয়ে ওঠার সম্ভাবনায় দীপ্ত হয়ে ওঠে। ‘ঐতিহাসিক’ ভাষণকে সে কারণেই হতে হয়, একই সঙ্গে ইতিহাসের ফসল ও স্রষ্টা—দুটোই।

এ তো গেল ভাষণের আধেয় বা মর্মবাণীর (কনটেন্ট) কথা। একটি ভাষণকে ঐতিহাসিক হতে হলে তার আধার বা উপস্থাপনের রূপও (ফরম) হতে হয় অনন্যসাধারণ। ফরম এবং কনটেন্ট—উভয় দিক থেকে বিবেচনা করে দেখতে হবে যে, কোনো একটি ভাষণকে, এ ক্ষেত্রে সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যুক্তিযুক্ত কি-না।

ইতিহাসের বীরপুরুষ ও মহানায়কের কণ্ঠ থেকেই নির্গত হয় ‘ঐতিহাসিক ভাষণ’। কিন্তু সবটাই কি শুধুই মহানায়কের বিমূর্ত একক ইচ্ছাশক্তি ও কৃতিত্বের ফসল? এ প্রশ্নের সঠিক মীমাংসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি সম্পর্কে ক্রিস্টোফার কডওয়েলের (তরুণ ব্রিটিশ মার্কসবাদী, যিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধে ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডের একজন সদস্য হিসেবে ফ্যাসিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে মাত্র ২৯ বছর বয়সে শহীদ হন) ‘এ স্টাডি ইন হিরোইজম’ প্রবন্ধ থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করছি। কডওয়েল লিখেছেন, “ইতিহাসের একজন ‘নায়কের’ (hero) পরিচয় কী উপাদানের দ্বারা সৃষ্টি হয়?...শুধু ‘নায়কের’ চারিত্রিক গুণাগুণ দিয়েই তা নির্ধারিত হয় না। পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি ও বাস্তবতাই একজন ‘নায়ককে’ সৃষ্টি করে।...সেই ব্যক্তির ভেতর কিছু থাকতে হবে এ কথা ঠিক, কিন্তু সেই ইতিহাসের ‘নায়করা’ দূরদ্রষ্টার মতো ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হন, তারা ইতিহাসের অনুকূলে কাজ করেন এবং এর ফলে এ রকম একটি ধারণা হয় যে, ইতিহাস পক্ষপাতমূলকভাবে সেই ‘নায়কের’ ইচ্ছার বা খেয়ালের কাছে ধরা দিয়েছে।”

৭ মার্চের ভাষণের প্রতি এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক। এ ভাষণের পটভূমিতে ছিল বাঙালি জাতির জাতীয় সংগ্রামের দীর্ঘ প্রেক্ষাপট। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গণসংগ্রামের বহুমাত্রিক প্রবাহ তার শীর্ষ ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর্বে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য ততদিন পরিপক্ব হয়ে উঠেছিল। ৭ মার্চের তাৎক্ষণিক প্রেক্ষাপটে ছিল ৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র বিজয় অর্জন এবং পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে তার সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন প্রাপ্তি, গণরায় বানচালের জন্য ইয়াহিয়া খান কর্তৃক পার্লামেন্টের অধিবেশন বাতিল ঘোষণা, ১ মার্চ থেকেই ‘স্বাধীনতার’ স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হওয়া, কারফিউ ঘোষণা, সেনাবাহিনী কর্তৃক গুলিবর্ষণ, এসব আঘাত মোকাবিলা করে ক্রমে আরও শক্তিশালী হতে থাকা প্রতিরোধ লড়াই, শহীদদের অব্যাহত আত্মদান, সশস্ত্র প্রতিরোধের স্বতঃস্ফূর্ত প্রস্তুতি শুরু ইত্যাদি।

এ পটভূমিতে সর্বত্রই চলছিল সভা, সমাবেশ, মিছিল, স্লোগান, বক্তৃতা ইত্যাদির জোয়ার। সে সময়টিতে দেশের অন্যান্য সব নেতার বক্তব্যই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কী বলেন, তার ছিল গুণগতভাবে পৃথক তাৎপর্য ও মূল্য। কারণ তিনি ছিলেন পাকিস্তানের অধিকাংশ নাগরিকের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আনুষ্ঠানিক নেতা। তদুপরি তিনি ছিলেন সমগ্র বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে একচ্ছত্র ম্যান্ডেট পাওয়া একক মুখপাত্র। জাতির পক্ষে কথা বলার নৈতিক কর্তৃত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুরই। এ ধরনের ক্রান্তিকালীন মুহূর্তে অন্যরা কোনো বেহিসেবি কথা বললেও তাতে ঘটনাবলি মৌলিকভাবে এদিক-সেদিক হওয়ার তেমন ভয় ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মুখের প্রতিটি উচ্চারিত বাক্যের ছিল আলাদা তাৎপর্য ও মূল্য। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন যে, ৬ মার্চের মধ্যে যদি ইয়াহিয়া সরকার দাবি না মেনে নেয় তবে ৭ মার্চ তিনি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন। তাই একদিকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আর অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল এটা দেখতে যে, সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু কী ঘোষণা দেন।

পরিস্থিতির ‘ডায়লামা’ ছিল এই যে, সশস্ত্র সংঘাত হয়ে পড়েছিল অনিবার্য। জনগণ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু সে জন্য সবদিক থেকে প্রস্তুতি তখনো সম্পন্ন হয়ে ওঠেনি। আরও কিছু সময় দরকার। এদিকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত আঘাত হানার আয়োজন এগিয়ে নিচ্ছিল। এমতাবস্থায়, একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার পরামর্শ কেউ কেউ দিচ্ছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল যে, তা করলে সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড হিংস্রতায় ‘ক্র্যাক ডাউন’ নেমে আসবে। একই সঙ্গে জনতার সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হবে। অনেকে আবার সন্দেহ ছড়াচ্ছিল যে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লোভে আপস করে ফেলতে পারেন।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অন্তর্নিহিত উপাদানের অসাধারণত্ব হলো, তিনি এই ভাষণের মাধ্যমে পরিস্থিতির সার্বিক জটিলতার মুখে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার পথে না গিয়ে সবকিছুর দায়ভার তিনি পাকিস্তানি শাসকদের ওপর ফেলে দিলেন। এভাবে তিনি পরিস্থিতিকে চূড়ান্তভাবে যাকে বলে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নের’ দিকে নিয়ে যাওয়ার পথ করে দিলেন। পাকিস্তান সরকারকে চারটি আঁটসাঁট শর্ত দিলেন। এগুলো মানা হলে তারপরে ‘ভেবে দেখব অ্যাসেমব্লিতে যাব কি যাব না’ বলে শেষ কার্ডটি নিজের হাতে রেখে দিলেন। পাকিস্তানিরা শান্তিপূর্ণভাবে স্বাধীনতার দাবি মেনে নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হওয়ার সুযোগও তিনি একই সঙ্গে খোলা রাখলেন।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’, ‘যার যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো’, ‘তোমাদের আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব’, ‘সর্বত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো’, ‘আর যদি একটা গুলি চলে...’, ‘যদি হুকুম দেবার নাও পারি...’—ইত্যাদি নির্দেশাবলি উচ্চারণ করলেন। তিনি বস্তুত, (de-fecto) সরকারি কাজের কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। অফিস-আদালত চললে কীভাবে চলবে, বেতন কবে দেওয়া হবে, রেডিও-টিভি কীভাবে চলবে, ইত্যাদি—বেসামরিক রাষ্ট্রযন্ত্রের যাবতীয় কাজ তখন থেকে তার নির্দেশেই পরিচালিত হবে বলে বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেসব নির্দেশনা মেনে দেশবাসী শুরু করে দিল সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকল সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি। এভাবে ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে জাতির সার্বিক ঐক্যের প্রতীক।

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক সংগ্রামে ছিল প্রধানত দুটি মূল ধারা। একটি ছিল জাতীয়তাবাদী ধারা। অন্যটি ছিল বামপন্থি ধারা। এ দুই ধারাসহ সব স্রোতধারার সম্মিলন ঘটিয়ে তিনি সেই অমোঘ বাণী উচ্চারণ করলেন—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিকে একটু অতিরিক্ত জোর দিয়ে উচ্চারণ করলেন। ফলে জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ‘নেতা’ স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। প্রস্তুতির কাজ সম্পর্কে তিনি নির্দেশনাও দিয়েছেন। ফলে ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনীর ক্র্যাক ডাউনের পর কী করতে হবে সে জন্য জনগণকে নির্দেশের অপেক্ষা করতে হয়নি। একই সঙ্গে, একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার হঠকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার কাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ফাঁদ পরিহার করাও সম্ভব হয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, পরে ২৬ মার্চ হানাদার বাহিনীর হামলা শুরুর পর চেতনায় কিছুটা পিছিয়ে থাকা দেশবাসীসহ বিশ্ববাসীর কাছে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা আর হঠকারী বলে বিবেচিত না হয়ে স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিভাত করা সহজ হয়েছিল।

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার প্রকাশভঙ্গি ছিল অসাধারণ। এটা কোনো বাক্যবাগীশতা ধরনের ভাষণ ছিল না। ১৮ মিনিটের ভাষণটি ছিল বাহুল্যবর্জিত, শব্দচয়নে ও বাক্যের বাঁধনে ছিল সহজবোধ্য, ঘরের আপন লোকের বাচনভঙ্গি দ্বারা ছিল অলংকৃত, প্রবহমান ঝরনার মতো ছিল সাবলীল। কণ্ঠস্বর ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কণ্ঠের মডুলেশন ছিল মন্ত্রমুগ্ধকর—আগাগোড়াই বজ্রনিনাদের আওয়াজ ও প্রয়োজনমতো জ্বালাময়ী। ভাষণের বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনের ফর্মের সঙ্গে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। সব মিলিয়ে সেটা ছিল ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণের এক ‘ঐতিহাসিক’ ভাষণ। ক্রিস্টোফার কডওয়েলের লেখা থেকে আবার উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি। তিনি লিখেছেন, “নিজের কর্মের যৌক্তিকতার স্বাক্ষর দেখে যাওয়ার আগেই কোনো ‘নায়কের’ মৃত্যু ঘটতে পারে। কিন্তু তার মৃত্যুর পরও তার শিক্ষা ও সূচিত ধারা বেঁচে থাকে। তিনি যে উদ্দেশ্য নিয়ে সংগ্রাম করেছিলেন, তা তার মৃত্যুকে অতিক্রম করে টিকে থাকে। আর, ‘বর্তমান’ অতিক্রম করে যা টিকে থাকে, সেটাই নিঃসন্দেহে ‘ভবিষ্যৎ’।”

মুক্তির সংগ্রামে এখনো আমাদের পরিপূর্ণ বিজয় আসেনি। মুক্তির পথে ‘ভবিষ্যৎ’ নির্মাণে ইতিহাসের অমূল্য রত্নভান্ডারের আমাদের অভাব কই! ‘মুক্তির পথ’ থেকে সরে গিয়ে বিপথে কেন—দ্বিধা কেন বন্ধু!

লেখক : বিশিষ্ট বাম রাজনীতিক ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com