নায়ক ফারুক ও আমাদের সিনেমা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

বাংলা চলচ্চিত্রের মিয়া ভাইখ্যাত নায়ক ফারুক আর নেই। নেই বললে মনে হবে তিনি ছিলেন। সেই অর্থে তিনি ছিলেনও না। ২০২১ সালের ৪ মার্চ চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান এবং আর ফেরেননি। আসল নাম আকবর হোসেন পাঠান, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন।

আমরা নায়ক ফারুকই বলছি, কিন্তু তিনি নায়কত্ব ও চলচ্চিত্র দুটোই ছেড়েছিলেন অনেক আগে। বাংলা সিনেমার সুবর্ণ সময়ের শিল্পী ফারুক। সিনেমা ছেড়ে শিল্পপতি হতে চেয়েছেন, সফল হননি। রাজনীতিতে এসে সংসদ সদস্য হয়েছেন, কিন্তু রোগ তাকে সেখানেও থাকতে দেয়নি।

একবার এক টক শোতে আমার সঙ্গে তিনি বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলছিলেন। আক্ষেপের সুরে বললেন, সিনেমা আর নেই এবং যেটুকু আছে সেটা তার জন্য নয়। নায়ক, নায়িকারা বুড়ো হলে বাংলা ছবিতে প্রথমে পার্শ্বচরিত্র, এরপর শুধু বাবা-মায়ের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। সারা ছবিতে সব মিলিয়ে সন্তান চরিত্রের নায়কের উদ্দেশে দু-একটি অতি পরিচিত সংলাপ ছাড়া আর কোনো রোল থাকে না তাদের।

অত্যাশ্চর্য, দ্রুতগতিতে বাংলা সিনেমার পতন হয়েছে। চলচ্চিত্রের প্রাণশক্তি ফেরানোর প্রচেষ্টা আছে অনেকের মধ্যে, দু-একটি ভালো ছবিও হচ্ছে। কিন্তু সামগ্রিক চিত্রটা হতাশাজনক। ধুঁকতে ধুঁকতে কোনোক্রমে বেঁচে আছে। রাজনীতির স্তরে বেশ কিছু নেতিবাচক মন্তব্য করেছে বরাহ শাবকরা, তবে নায়ক ফারুকের মৃত্যুতে তার ভক্তরা কষ্ট পেয়েছে। তার মৃত্যুর পর মানুষ শোক জানিয়েছে যা নতুন করে আশার আলো জাগায় যে, একজন নিবেদিতপ্রাণ চলচ্চিত্রকর্মীর জন্য এখনো এ দেশের মানুষের ভালোবাসা আছে। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্র জগৎ যে একটি ক্ষুদ্র, পরিচিত এবং অভ্যস্ত বৃত্তের মধ্যে সীমিত হয়ে ক্রমেই লুপ্তপ্রায় সে জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো বার্তা নেই কোথাও।

অনেকেই বলেন, বাংলা সিনেমার এ পরিণতি অভাবনীয় ছিল। কারণ, তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিকতা কখনো ছিল না। একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, বাংলা সিনেমা কখনোই কোনো ঈর্ষণীয় উচ্চতায় ছিল না, শৈল্পিক মানও এমন অভাবনীয় জায়গায় ছিল না, কিন্তু ছিল তার প্রাণ।

এ জগতের অবক্ষয় চলছে দীর্ঘকাল ধরে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এর উত্তরণ নিয়ে আপাতত কোনো আশার আলো চোখে পড়ছে না। মামুলি, তুচ্ছতাসর্বস্ব, অবিন্যস্ত আমাদের চলচ্চিত্রের বাজার। দু-একটি হঠাৎ হঠাৎ আসা ছবি নাগরিক সমাজে কিছু আলোচনা জন্ম দেয় বটে, কিন্তু এগুলো এই শিল্পকে এগিয়ে নেয় না। এসব শহুরে ছবির দর্শক আলাদা। এসব তারা দেখেন যারা মূলত মাল্টিপ্লেক্সে যান, কিংবা ওটিটি জগতে দেখেন। সেই কবে থেকে আমাদের বাণিজ্যিক ছবির বাজার মরা। সিঙ্গেল স্ক্রিন হলগুলোর অবস্থা ক্রমেই পড়তি। সারা দেশে সিঙ্গেল স্ক্রিন হলের সংখ্যা কমছে আর কমছে। সেগুলো পরিণত হচ্ছে বহুতল বাণিজ্যিকভাবে। কারণ, এফডিসিতে উৎপাদিত বাংলা ছবি চালিয়ে সেসব আর জিইয়ে রাখা যায়নি, যাচ্ছেও না। উপায়হীন হয়ে হলমালিকরা বাঁচা-মরার হিসাব করছেন এখন ভারতীয় ছবি চালানোর মধ্য দিয়ে। ক্ষুদ্রতায় আক্রান্ত একটি গোষ্ঠী সেটাও বন্ধ করতে চায়। তারা বুঝতেই পারছেন না যে, শাহরুখ খানের পাঠান বা ভারতীয় ছবি হলমালিকদের জন্য বাঁচার অক্সিজেন মাত্র।

স্বাধীনতার আগে থেকেই ঢাকাই ছবির একটা আলাদা ভুবন তৈরি হয়েছিল। মিষ্টি নিটোল প্রেম ও গানের ছবি রুচিশীল মধ্যবিত্তসহ সব শ্রেণিকেই আকর্ষণ করত। পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী, পরিবেশক সবার সমবেত উদ্যোগে আমাদের চলচ্চিত্র ছুটত সারা দেশে। তার সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ত শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। নায়ক রাজ রাজ্জাক, কবরী, ফারুক, সুচরিতা, ববিতা, আলমগীর, জাফর ইকবাল, শাবানাদের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সারা দেশে পরিচিতি পেয়েছিলেন, যশও জুটেছিল তাদের কপালে।

তারপর একদিন সব কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কেউ ভাবতেও পারেনি যে, এমন বিস্তৃত ব্যবস্থা একদিন দুম করে ধ্বংস হয়ে যাবে। কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে, শেষ হয়ে যাবে সিনেমার গরিমা। কী ঘটেছিল আসলে? দক্ষতার অভাবজনিত কারণে হোক, আর্থসামাজিক কারণেই হোক, এক শুভ প্রভাতে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগৎ আবিষ্কার করল যে, তার দর্শকসংখ্যা হঠাৎ কমেনি, হয়ে গেছে।

তাকে বাঁচাবার চেষ্টা তো হলোই না, ঘটল ভিন্ন কিছু। বস্তাপচা কাহিনি, দুর্বল নির্মাণ, সম্পাদনা সব মিলিয়ে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হলো যে, ভদ্রলোক পাবলিক হলে যাওয়া ছেড়ে দিল। পরিবার নিয়ে কেউ আর যায় না সিনেমা দেখতে—এমন একটা কথাও চালু হয়ে গেল। ফলে এ জগৎ হয়ে গেল তাদের যারা ঘাম-চিটচিট শরীরে সিনেমা দেখতে আসে তাদের এবং এ ভাবনাই এ শিল্পের কর্ণধারদের মনোজগতেও ঢুকে গেল। গোটা চলচ্চিত্র পাড়াটা খিস্তি খেউড় করা আজব শ্রেণিতে ভরে গেল যেটা আমরা বিগত শিল্পী সমিতি নির্বাচনে দেখলাম। শিল্প কাকে বলে, সিনেমা কাকে বলে সেটা ঠিক করছে এই উদ্ভট ভাবনার লোকগুলোই। সঙ্গে বিষফোড়ার মতো এলো অর্থকরী সমস্যা। বড় বিনিয়োগ কমে গেল। গাঁজাখুরি সিনেমা চালিয়ে চালিয়ে হলগুলো আর ব্যবসাও করতে পারল না। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প যুক্ত হতে পারল না প্রযুক্তির সঙ্গেও। ভিসিআরের প্লাবনে বলিউড সিনেমার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার সংগ্রাম করেছে নকল ছবি তৈরি করে, কিন্তু রক্ষা হয়নি।

স্যাটেলাইট টেলিভিশনের যুগে, ইন্টারনেটের আমলে জগৎটা যখন উন্মোচিত হলো মানুষের সামনে তখন সে লড়াই হারারই ছিল। কারণ সময়ের সঙ্গে চলতে পারেনি এফডিসিপাড়া। অনেক সমিতি, অনেক রাজনীতি, অনেক কলহ এই পাড়ায়। কিন্তু সিনেমা এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনায় সর্বাঙ্গীণ নীরবতা। কোনো কথা নেই কোথাও। কীভাবে এগোনো যায়, সেই আলাপও নেই। আমাদের শিল্প সংস্কৃতির সব শাখার মধ্যে সিনেমা এখন সবচেয়ে প্রান্তিক।

সময় এসেছে ভাবনার জগতে পরিবর্তন আনার। চলচ্চিত্র হলো একটি জাতির সৃজনশীল বহিঃপ্রকাশ। এখন যারা এফডিসিতে ছবি নির্মাণ করছে সেখানে সংস্কৃতি আছে কি না দেখতে হবে। বলা হয় ভালো গল্পের অভাব। কিন্তু গল্প আসবে কোথা থেকে? সংস্কৃতির চর্চা যারা করেন তাদের সঙ্গে ওঠাবসা নেই এফডিসিকেন্দ্রিক চক্রের। তাই নাগরিক মন পড়তে পারেন না তারা।

প্রথম কাজ হল বাঁচানো। শুধু শুনতে হয় একের পর এক হল বন্ধের খবর। ঢালিউড বলা হয় ঢাকাই ফিল্ম জগৎকে। কিন্তু সিনেমার ছিটেফোঁটাও নেই এখানে। আছে শুধু নোংরা রাজনীতি। কে কাকে বহিষ্কার করছে, কে কাকে হুমকি দিচ্ছে, এসব ছাড়া কোনো গল্প নেই এই পাড়ায়। পাড়া থেকে সিনেমার জগৎ বানাতে হবে এফডিসিকে। যে দু-একজন যোগ্য আছেন, তাদের জায়গা দিতে হবে। যেসব তরুণ ভালো ছবি নির্মাণ করছেন তাদের হাতে নেতৃত্ব ছাড়তে হবে।

আর সেন্সরের খপ্পর থেকে সিনেমাকে বাঁচাতে হবে। শনিবারের বিকেলের মতো ছবি আটকে রাখার অর্থ হলো শিল্পকে বন্দি করে রাখা। ‘প্রোডাক্ট’ হিসেবে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তফাতটা শুধুই অর্থনৈতিক নয়। অনেক বেশি শিক্ষা আর রুচির। ভালো ছায়াছবির চাহিদা আছে। আমরাই জোগান দিতে বিমুখ। ছোট পুকুর থেকে বড় পুকুরে নিয়ে যেতে হলো এ জগতের লোকদের ‘পাড়া’ মানসিকতা ছাড়তে হবে। সরকারি নীতিনির্ধারণী জায়গায়ও মানসিকতা পরিবর্তন আনতে হবে। চলচ্চিত্রের বড় বিচারক মানুষ। চলচ্চিত্র মানুষের, এর উৎসবও মানুষেরই।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

এ সম্পর্কিত খবর

No stories found.
logo
kalbela.com